পাখির মতো মানুষ মারছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:২৮ পিএম

রবিবার মিয়ানমারে সেনা শাসন বিরোধী বিক্ষোভ দমনে পুলিশ গুলি চালায়


ফাইল ছবি

আহত একজনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে

মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চির মুক্তি দাবিতে রবিবার নারীদের বিক্ষোভ হয়

রোববার বিক্ষোভের মধ্যে রাস্তার পাশে পড়ে আছেন গুলিবিদ্ধ গণতন্ত্রপন্থি এক বিক্ষোভকারী

রবিবার বিক্ষোভ দমনে রাজপথে নামে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ছবি সংগৃহীত

পায়ে গুলি লেগে আহত একজন বিক্ষোভকারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গীরা। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস
যেনো পাখির মতো মানুষ মারছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বিক্ষোভ দমাতে না পেরে এতোটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে তারা। পরিণতিতে সেনা অভুত্থানের পর চলমান জান্তা বিরোধী বিক্ষোভে একদিনে ১৮ জন নিহতের মধ্যে দিয়ে রবিবার সবচেয়ে রক্তাক্ত দিনে পরিণত হয়েছে। পুলিশের স্টান গ্রেনেড, টিয়ার শেল, ফাঁকা গুলি কিছুই তাদের দমাতে পারছে না। বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করতে শেষ পর্যন্ত গুলি ছুঁড়তে থাকে জান্তা সরকারের সেনাসদস্য ও দাঙ্গা পুলিশেরা। আর হতাহতের রক্তে লাল হয়ে ওঠে রাজপথ। আহত রক্তাক্ত অনেককে রাজপথে পড়ে থেকে সহযোগিতার আশায় চিৎকার করতে দেখা যায়। দেশটিতে তুমুল জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে রবিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন আরও অনেক। গ্রেপ্তার হয়েছেন সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ। মিয়ানমারের ফার্স্ট কার্ডিনাল চার্লস মোং বো বলেন, মিয়ানমার এখন কার্যত যুদ্ধক্ষেত্র। খবর বিবিসি, গার্ডিয়ান ও রয়টার্সের।
জান্তাবিরোধী বিক্ষোভের সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন, নিহত ১৮
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দপ্তরের এশিয়া শাখা জানায়, রবিবারের বিক্ষোভে অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন। গত ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর চলমান বিক্ষোভে গণতন্ত্রের জন্য এ পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন ২১ জন। রবিবার আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। বিক্ষোভ থেকে সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা দেশটিতে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে সবচেয়ে প্রাণঘাতী এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে।
[caption id="attachment_268243" align="alignnone" width="894"]
রোববার দেশটির বিভিন্ন স্থানে কারাবন্দী অং সান সু চির মুক্তি এবং সেনাশাসনের অবসানের দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নিতে রাস্তায় নেমে আসেন হাজারো মানুষ। বিক্ষোভ ঠেকাতে সকাল থেকেই পুলিশ ছিল মারমুখী। গণমাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হচ্ছে, রাজধানী নেপিদো, ইয়াঙ্গুল ছাড়াও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাসিও এবং দেশটির একবারের দক্ষিণের মায়েক শহরে পুলিশ ব্যাপক দমন-পীড়ন চালায়। মিয়ানমারের বিভিন্ন শহর থেকে বিক্ষোভে নিহত হওয়ার খবর আসছে। ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়, দাওয়েই শহরে মারা গেছেন অনেকে। মায়েক, বাগো, পুকোকু শহর থেকেও মৃত্যুর খবর আসছে। হাসপাতাল সূত্র ও স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে এসব কথা বলা হচ্ছে।
[caption id="attachment_268222" align="alignnone" width="896"]
সেনাবাহিনী বলছে, একজন পুলিশও বিক্ষোভে নিহত হয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা জাতিসংঘকে দ্রুত কার্যকরী প্রদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এক বিক্ষোভকারী টুইটারে লিখেছেন, ‘জাতিসংঘের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আর কত প্রাণ বলিদান দিতে হবে।’
দেশটির রাজনীতিক এবং চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দেশজুড়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনী টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছে। বিক্ষোভকারীদের দিকে পাখির মতো গুলি করেছে তারা।
[caption id="attachment_268203" align="alignnone" width="925"]
এর আগে রয়টার্সের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, রবিবার সকালের দিকে মিয়ানমারের বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়। শিক্ষকদের বিক্ষোভে স্টান গ্রেনেড, গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে পুলিশ। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও রাজপথে নামে। শুরু হয় গুলিবর্ষণ। রক্তরঞ্জিত হয় রাজপথ। এ শহরে অন্তত ৫ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে বুকে গুলিবিদ্ধ একজনকে হাসপাতালে নেওয়ারে পরপরই মারা যায়। গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া এসব মানুষের মধ্যে একজন শিক্ষকও আছেন।
এদিকে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে অন্তত তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে এক নারী। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। শহরটির বাগো এলাকায় প্রাণ হারান এক জন। মান্দালয়ের নিহতদের একজন চোখে গুলিবিদ্ধ হন।
দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় দাওয়েই শহরে পুলিশের দমন-পীড়নে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত চার জন গণতন্ত্রকে ভালোবাসা মানুষ।
[caption id="attachment_268209" align="alignnone" width="937"]
আগের দিন শনিবারও জান্তা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। দেশটির দাওয়েই শহরে, বিক্ষোভকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করতে গেলে বাধা দেয় দাঙ্গা পুলিশ। এ ছাড়া দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ম্যান্দালয়ে এদিন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে যোগ দেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও। এ সময় হাতে প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার দিয়ে জান্তা সরকারবিরোধী স্লোগানের পাশাপাশি অবিলম্বে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান বিক্ষোভকারীরা।
এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে দুজন নিহত হন। এর এক দিন আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন ফিরিয়ে আনার দাবিতে চলমান এই বিক্ষোভে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মিয়া থোতে থোতে খায়ং (২০) নামের এক নারী বিক্ষোভকারী রাজধানী নেপিদোর এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। গণতন্ত্রের জন্য এবারের আন্দোলনে দেশটিতে তিনিই প্রথম প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
[caption id="attachment_268242" align="alignnone" width="938"]
এদিকে সেনা অভ্যুত্থানের সমালোচনা করে শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।
সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেত্রী অং সান সু কির নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটায় সেনাবাহিনী। গ্রেপ্তার করা হয় সু কিসহ এনএলডির শীর্ষ নেতাদের। মাস কেটে গেলেও এসব গণতন্ত্রপন্থি নেতা মুক্তি পাননি। উল্টো তাদের আটক রাখার নান ফন্দি করছে জান্তা সরকার। সু কির বিরুদ্ধে করা হয়েছে একাধিক মামলা। এরই মধ্যে তাকে গৃহবন্দি অবস্থায় রেখে রুদ্ধদ্বার বিচার শুরু হয়েছে। সু কিকে তার আইনজীবীর সহায়তা নেওয়ারও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বিশেজ্ঞরা বলছেন, সু কি কিভাবে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায়, তারই অপকৌশল এসব মামলা ও বিচার। এ আসলে দেশটির জগণের চোখে ধুলো দেওয়ার প্রহসন।