রবিবার আসতে পারে কপ-২৯ ঘোষণাপত্র
বাকু জলবায়ু সম্মেলনে তহবিল বরাদ্দ নিয়ে হতাশা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৯ এএম

জলবায়ু সম্মেলনের বর্ধিত সময় গতকালও পক্ষগুলোর মধ্যে শেষ মুহূর্তের দর-কষাকষি হয়। এ সময় দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেন অধিকারকর্মীরা। শনিবার (২৩ নভেম্বর) আজারবাইজানের বাকুতে। ছবি: রয়টার্স
আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৯ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে। শনিবার (২৩ নভেম্বর) বৈঠক শেষ হওয়ার পর এখন সামনে অপেক্ষা করছে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্ভাব্য ঘোষণাকে একে ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সুইডেনের খ্যাতিমান জলবায়ু অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রবিবার বাংলাদেশ সময় সকালে ঘোষণা আসতে পারে তবে এ ঘোষণায় কপ-২৯ সম্মেলনের অংশ নেয়া দেশগুলোতে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি থাকছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বাকু সম্মেলনের আলোচনায় বিশ্বজুড়ে জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে কোনো সমাধান আসেনি। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বছরে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন (১ লাখ ৩০ হাজার কোটি) ডলার তহবিলের দাবিতে সোচ্চার হলেও, শিল্পোন্নত দেশগুলো মাত্র ৩০০ বিলিয়ন (৩০ হাজার কোটি) ডলার দিতে রাজি হয়েছে। তাও ওই অর্থ তারা এককভাবে দিতে চায় না; চীন, ভারত ও ব্রাজিলের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোও তহবিলে অর্থ জমা দিতে হবে বলে শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান ও হতাশা
বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কপ-২৯ সম্মেলনের বিষয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব অত্যন্ত অপ্রতুল। রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, এই অর্থ অনুদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি এবং কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থার আওতায়ও নেই। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫টি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) বিশেষ তহবিলের আওতায়ও নেই, যা আরও হতাশাজনক। তিনি আশা করেছিলেন, বিশ্ব ব্যাংক ও উন্নয়নশীল দেশগুলো তহবিলের জন্য বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করবে, কিন্তু তাদের এই সদিচ্ছা প্রকাশ পায়নি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন জানান, সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে তারা কিছুটা আশাবাদী, তবে জলবায়ু তহবিলের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে জলবায়ু তহবিলের জন্য আরও সোচ্চার হতে হবে, তবে প্রকল্প পেতে হলে আমাদের আরও দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি ও বাস্তবায়ন, পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে।
পর্যবেক্ষকদের মতামত: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও তহবিলের সংকট
কপ-২৯–এর পর্যবেক্ষকদের মতে, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্যারিস চুক্তির বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা পুনরায় ক্ষমতায় আসছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী জয়, কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও ফ্রান্সের ডানপন্থী জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার ফলে জলবায়ু তহবিলের জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলো ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়নি।
বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা
জাতিসংঘের জলবায়ু বিজ্ঞানীদের সংগঠন আইপিসিসি (IPCC) জানিয়েছে, এই শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ানোর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায় প্যারিস চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল, কিন্তু গত ২৪ বছরে তাপমাত্রা ইতিমধ্যে ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ ৪৩ শতাংশ কমানো জরুরি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপানসহ বিশ্বের প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
শেষ মুহূর্তে সম্মেলন বর্জন
বাকু সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট এওসিস এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে সম্মেলন বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তারা অভিযোগ করেন, জলবায়ু তহবিলের অর্থ বরাদ্দ না হওয়ার কারণে এবং ধনী দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির দিকে যথাযথ মনোযোগ না দেওয়ার জন্য সম্মেলন বর্জন করা হয়েছে।
কপ-২৯ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলো বিশ্বব্যাপী ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী, এবং তাদের কম প্রতিনিধিত্ব এবারের সম্মেলনে প্রকাশ পেয়েছে।
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ: তহবিল বৃদ্ধির জন্য আরো সোচ্চার হতে হবে
কপ-২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্রতিনিধিদলের সদস্য জিয়াউল হক জানিয়েছেন, অনেক হতাশার মধ্যেও সম্মেলনে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। শেষ সময়ে এসে তহবিলের অর্থ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। প্যারিস চুক্তির ৯ দশমিক ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় তহবিলের অর্থ বাংলাদেশের মতো জলবায়ু–বিপন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ হবে, এবং বাংলাদেশকে তহবিল পাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
কপ-২৯ সম্মেলন শেষ হলেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের অগ্রগতি নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য তহবিল বৃদ্ধি এবং সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সোচ্চার হতে হবে।