বেনারসি শাড়ির শিল্পীরা পেটের দায়ে শ্রমিকের কাজ করছে

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ০২:১৬ পিএম

বেনারসি শাড়ির শিল্পীরা পেটের দায়ে শ্রমিকের কাজ করছে। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লোকসভা কেন্দ্র বানারসের ভেলুপুরে রমজান আলীদের ৩ প্রজন্মের পুরনো শাড়ির ব্যবসা। পুরনো শাড়ির দোকানে বসেই তিনি করেন বেচাকেনা। এর কিছুটা দূরেই সম্প্রতি খুলেছেন নতুন একটি শাড়ির শো-রুম। শাড়ির বিক্রি আগের মত নেই বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন। খবর আনন্দবাজারের।
তিনি গণমাধ্যমে কথা বলার সময় প্রতিবেদকের হতে দুটো শাড়ি তুলে দিয়ে বলে দেখুন, ওজনেই বুঝতে পারবেন কোনটা তাঁতে তৈরি, আর কোনটা মেশিনে!
রমজান আলি তার কোলে এক জোড়া বেনারসি শাড়ি মেলে ধরেন। যেখানে একটা শাড়ির দাম ৩০ হাজার টাকা আর অন্যটার দাম ৫ হাজার। ৩০ হাজার টাকার শাড়ি পালকের মতো হালকা। অন্যদিকে ৫ হাজার টাকার শাড়ি বেশি ঝলমল করছে, ওজনেও অনেকটা ভারী।
তিনি আরো বলেন- ‘সবাই এসে ৫-৬ হাজার টাকার বেনারসি শাড়িই কিনে নিয়ে যায়। এমনিতেই নোট বাতিলের পর থেকে বিক্রিবাটা কম। তার উপর জিএসটি, কোভিড এসে কোমর ভেঙে দিয়েছিল। এখন বিক্রিবাটা কিছুটা বাড়লেও ব্যবসা আর আগের মতো নেই। লোকজন আর আগের মত করে টাকা খরচ করতে চাচ্ছে না, মেশিনে তৈরি কম দামি শাড়ির চাহিদা তাই বেশি। তাতে তৈরি আসল বেনারসি শাড়ির বিক্রি খুবই কম। সব থেকে মার খাচ্ছেন তাঁতিরা। আফসোসের সুর রমজান আলির মুখে।
নরেন্দ্র মোদীর লোকসভা কেন্দ্র বানারসের ভেলুপুরে রমজানদের ৩ প্রজন্মের পুরনো শাড়ির ব্যবসা। রমজানদের শাড়ির আড়ত থেকে গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, বড়বাজারের বিভিন্ন বিপণিতে বেনারসি শাড়ি পাঠানো হয়। কিন্তু তার মুখে হাসি নেই। কারণ, বেনারসি শাড়ির তাঁতিদেরই নাভিশ্বাস উঠেছে। রোজগার কমায় বেনারসি শাড়ি বোনার কাজ ছেড়ে দলে দলে তরুণরা কেউ সুরাটে, কেউ বেঙ্গালুরুতে কাজ করতে চলে যাচ্ছেন। কেউ হোটেল-রেস্তরাঁয় কাজ করছেন বা টোটো চালাচ্ছেন।
বানারসের মদনপুরা, ভেলুপুর, পিলি কোঠি, ডাল মান্ডি, আলেইপুরের অলিগলিতে বেনারসি শাড়ির আঁতুড় ঘর। ১ জুন ভোটের আগে প্রশ্ন উঠেছে, নরেন্দ্র মোদী বানারসের সংসদ সদস্য হয়ে বেনারসি শাড়ি শিল্পের জন্য কী করেছেন? কেন তিনি তাঁতিদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারলেন না?
রমজানের শাড়ির গদিতে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন এহসান আলি। বানারসের কাছে আলেইপুরের তার বাড়িতে আছে শাড়ি তৈরির তাঁত। এহসানদের পরিবার গত একশো বছর ধরে বেনারসি শাড়ি বুনছে।
প্রতিবেদককে এহসান বলেন- ‘বাপ, দাদা, পরদাদা, সবাই শাড়ি বোনার কাজ করতেন। এখন আমরা ৪ ভাই শাড়ি বোনার কাজ করি। ৪ জন কাজ করে মাসে ১০-১২ হাজার টাকার বেশি রোজগার করতে পারি না। কারণ, এখন হাতের তাঁতে তৈরি বেনারসি শাড়ি কদর কমেছে। মাসে হয়ত ২-১টা অর্ডার পাওয়া যায়। হ্যান্ডলুমে একটি শাড়ি বুনতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগে, তবে এতে আয় হয় বেশি। সেই তুলনায় পাওয়ারলুমে মাসে ৪০টি শাড়ি তৈরি করা যায়, কিন্তু তাতে বেশি মজুরি পাওয়া যায় না।’
বানারসের গোধূলিয়া মোড় থেকে দেড় মাইল দূরে পিলি কোঠি এলাকায় ঘরে ঘরে বেনারসি শাড়ি বোনা হয়। আরফিন আনসারির ঘরে দিনরাত চলে পাওয়ারলুম। বিদ্যুৎ বিলের জোগান দিতেই তাদের ঘাম ছুটে যায়। সমাজবাদী পার্টির সরকারের আমলে বিদ্যুতের ভর্তুকি দেয়া হত। যোগী আদিত্যনাথ সরকারের আমলে সেই ভর্তুকি তুলে দিয়ে নতুন মাসুল নীতি চালু হয়।
আনসারি বলেন- ‘আগে ৭৫ টাকা বিল আসত। এখন ৮০০-৯০০ টাকা বিল আসে। এ নিয়ে অনেক আন্দোলন, অনুরোধ, দরবার করা হয়েছে। লাভ হয়নি।’
রমজান আলির মতো বানারসের প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ বেনারসি শাড়ি শিল্পের উপরে নির্ভরশীল। দেশের প্রধানমন্ত্রীর লোকসভা কেন্দ্রে সেই বেনারসি শাড়ির শিল্পে এখন সর্বত্র হাহাকার। নোট বাতিল, কোভিডের ধাক্কায় ব্যবসায় মন্দাভাবে রোজগার কমছে তাদের। পাওয়ারলুমে শাড়ি তৈরি হচ্ছে বলে তাঁতিদের মজুরি কমছে। এক-একটি শাড়ির গায়ের কারুকার্য বা নকশা এঁকে দেয়ার জন্য নকশাদাররা এক থেকে দুই হাজার টাকা পান। শাড়ির বিক্রি কমায় তাদেরও রোজগার কমেছে।
বানারসের অলি-গলিতে ঘুরলে গুঞ্জন শোনা যায়, গুজরাট থেকে নরেন্দ্র মোদী এসে বানারসে ভোটে লড়ছেন। স্থানীয়দের মতে বেনারসি শাড়ির সুতা, যন্ত্রাংশ সবই আসছে গুজরাট থেকে। অন্যদিকে বানারসে কারখানা তৈরির দাবি থাকলেও তা এখনো পূরণ হয়নি। কিন্তু এ সব নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ- ‘এই বেনারশি শাড়ি নিয়েও শুরু হয়েছে ধর্মীয় ভেদাভেদের রাজনীতি। মদনপুরার এক প্রবীণ তাঁতি বলেন, যারা শাড়ি বোনে তাদের ৮০ শতাংশই মুসলিম। অন্যদিকে শাড়ির গদ্দিদারদের বেশিরভাগই হিন্দু। শাড়ি যেমন তানা-বানার সুতোয় বোনা হয়, এতদিন বেনারসি শাড়ি তৈরিতে দুই ধর্মের মানুষ তানা-বানার মতো একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে ছিল। এখন তাঁতিদের মনে ধারণা তৈরি হয়েছে, তারা মুসলিম বলেই মোদী বা যোগী সরকার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না । অন্যদিকে বিজেপি বলছে- ‘শুধু মুসলিমরাই অভাব-অভিযোগ করছে। এখানকার বিদ্যমান সমস্যাগুলো মোকাবেলায় বিজেপির নেতৃত্বে বুনকর হিন্দু যুবা বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। তার সবসময় তাঁতিদের পাশে থেকে সাহায্য-সহযোগিতা করছে।’
উল্লেখ্য, সপ্তদশ শতাব্দীতে গুজরাটে দুর্ভিক্ষের জেরে তাঁতি ও ব্যবসায়ীরা উত্তর ভারতে চলে এসেছিলেন। মোগল সম্রাটদের আনুকূল্যে তাঁতিরা পরবর্তী সময়ে বানারসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। বানারসে বসবাস করা তাতিদের তাতে বোনা বিশেষ সিল্কের শাড়ি বেনারসি শাড়ি নামে পরিচিত।
আরো পড়ুন: ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলো বেলজিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়
রমজান আলি বলেন- ‘একসময়ে এখানকার বসবাসকারী তাঁতিদের ছেলে-মেয়েরা এখন কাজ ছেড়ে বাধ্য হেয় গুজরাটের সুরাটে সিনথেটিক শাড়ির কারখানায় মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে শাড়ির তাঁত বিক্রি করে টোটো কিনে চালাচ্ছে।’
আক্ষেপের সুরে রমজান বলেন- ‘কী করবে? শাড়ি বুনলে দিনে ৩০০ টাকা রোজগার হয়। টোটো চালিয়ে তো আহ হয় মোটে পাঁচ থেকে সাতশো টাকা। একসময়ের শাড়ি তৈরি শিল্পীরা এখন ভাগ্যের বিড়ম্বনায় শ্রমিক হয়ে যাচ্ছেন, এটাই দুঃখের।’