নার্সদের কর্মবিরতি
হাসপাতালে রোগীর ভোগান্তি

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি : ভোরের কাগজ
জ্বর ও ডায়রিয়া নিয়ে গত পরশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১২ বছরের আবীর। আবীরের বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, ছেলেটা ভর্তি হয়েছে পরশু। ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। সকালে স্যালাইন দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নার্সতো নেই। দুপুর সাড়ে ১২টা বেজে গেছে কিন্তু ছেলেটার স্যালাইন দেয়া হলো না।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার সকালে ভর্তি হয়েছেন কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন (২৩)। গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ভর্তি হলেও দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো নার্সের দেখা পাননি বিল্লাল। তিনি বলেন, জরুরি বিভাগ থেকে ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে সব লিখে দিয়েছে। কিন্তু কোনো চিকিৎসা এখনো শুরু হয়নি।
ঢাকা মেডিকেল কিংবা মিটফোর্ড হাসপাতালই নয়; গতকাল দেশের সব সরকারি হাসপাতালের চিত্রই ছিল এমন। ডাক্তাররা এসে রুটিন রাউন্ড দিয়েছেন, নতুন প্রেসক্রিপশনও লিখে দিয়ে গেছেন। কিন্তু সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কোনো ওষুধ পাননি রোগীরা। এক দফা দাবিতে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা নার্সদের কর্মবিরতিতে দুর্ভোগে পড়েন রোগীরা। আন্দোলনকারীরা যদিও বলেছে জরুরি বিভাগ, ডায়ালাইসিস, জরুরি অস্ত্রোপচার, আইসিইউ, পিআইসিইউ, এনআইসিইউ এ কর্মসূচির বাইরে। কিন্তু সরজমিন দেখা গেছে, কর্মসূচি চলাকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নার্স না থাকায় সেখানকার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। কয়েকজন নার্সকে অস্ত্রোপচার কক্ষের পোশাক পরেই কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে।
রোগীর সেবায় নার্সদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শ ও নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীদের ইনজেকশন দেয়া, ওষুধ খাওয়ানো, শরীরের তাপমাত্রা মাপা, ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করাসহ রোগী ব্যবস্থাপনার কাজগুলো নার্সরাই করেন। তাদের কর্মবিরতির সময়টায় সেবা না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েন হাসপাতালে ভর্তি ও বহির্বিভাগে আসা রোগীরা। নতুন রোগী ভর্তির কাজও ওই সময় বিরত ছিল।
কর্মবিরতির কারণে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং ইনডোরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নার্সরা কেউ ছিলেন না। টেবিলে লেখা ছিল ‘কর্মবিরতি’। হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে কর্মসূচি পালন করেন নার্সরা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন করেন নার্সরা। ওই সময় হাসপাতালের কোনো ওয়ার্ডে নার্স ছিলেন না। কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানের প্রধান ভবনের সামনে মিছিল করেন নার্সরা। সেই মিছিলে অস্ত্রোপচার কক্ষের পোশাক পরেই কয়েকজন নার্সকে অংশ নিতে দেখা গেছে।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) কর্মবিরতি পালনের অংশ হিসেবে ব্যানার নিয়ে হাসপাতাল চত্বরে অবস্থান নেন নার্সরা। দাবি আদায়ের জন্য তারা নানা ধরনের বক্তব্যও দেন। হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা রোগীদের সেবা কার্যক্রম ওই সময় বন্ধ ছিল।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের চিত্রও এমনই ছিল। প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র স্টাফ নার্স মো. মতিউর রহমান বলেন, আমাদের এক দফা দাবি মেনে না নেয়ায় আমরা হতাশ হয়েছি। আমরা আর বাইরে থাকতে চাই না, আমরা চাই, আমাদের রোগীর সেবায় নিজেদের নিয়োজিত রাখতে। আমরা চাই, ২০১৬ সালের নিয়োগবিধি দ্রুত বাস্তবায়ন করে নার্সদের পদন্নোতির মাধ্যমে শূন্যপদগুলোতে পদায়ন করা হোক। সেই সঙ্গে নার্সিংয়ে সেবা ক্যাডার দ্রুত চালু করা হোক। আমরা অর্গানোগ্রাম এর সঠিক বাস্তবায়ন চাই। অতিরিক্ত দায়িত্ব, নিজ বেতনে অতিরিক্ত দায়িত্ব, চলতি দায়িত্ব আর চাই না।
রোগীদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করেন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সংস্কার পরিষদের অন্যতম সদস্য সাব্বির মাহমুদ তিহান। তিনি বলেন, রোগীরা কষ্ট পাচ্ছেন জানি। কিন্তু আমাদের দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমরা কর্মবিরতিতে আছি। তবে জরুরি বিভাগ ও মুমূর্ষু রোগীদের সেবার জন্য আমরা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি।
রোগীদের ভোগান্তির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সংস্কার পরিষদের আহ্বায়ক ড. মো. শরিফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রোগীদের সাময়িক ভোগান্তি হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু দাবি আদায়ে আমাদের আর কোনো পথ নেই। জরুরি বিভাগসহ কিছু জায়গা কর্মবিরতির বাইরে থাকবে- এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপরও কেউ সেখানে না থাকলে আমরা খোঁজ নিচ্ছি, এমন যেন না করে।
প্রসঙ্গত; নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক এবং কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও রেজিস্ট্রার পদে যোগ্য ও অভিজ্ঞ নার্সদের পদায়নের দাবিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে কর্মসূচি পালন করে আসছেন নার্সরা। ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ১ অক্টোবর সারাদেশে ৩ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করেন তারা। পরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় কর্মসূচি স্থগিত করা হয়। কিন্তু ৬ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে দুজন নার্সিং কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে পরিচালক পদে পূর্ণ দায়িত্ব না দিয়ে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্বে পদায়ন করেন। এ কারণে পুনরায় কর্মবিরতিতে নামে নার্সরা।