ভয়েস অব আমেরিকাকে ড. ইউনূস
সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, সেটা সরকারই জানাবে

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের যে সময়ের কথা বলেছেন সে বিষয়ে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জানতে চায় ভয়েস অব আমেরিকা। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এটা সরকারের মতামত নয়। সরকার কখন মেয়াদ ঠিক করবে, সেটা সরকারকে বলতে হবে। আমাদের মুখ থেকে যখন শুনবেন, তখন সেটাই হবে তারিখ। উপদেষ্টা পরিষদে আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করেছি, কিন্তু এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। গত শুক্রবার জাতিসংঘে ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে দেয়া ভাষণ শেষে নিউইয়র্কে ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আনিস আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টার এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে সোমবার। এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকার দেন সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে দেশে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে যেন সক্ষম হয়, সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তার দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাওয়ার কথা জানান সেনাপ্রধান।
সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ভয়েস অব আমেরিকাকে জানান, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের ভূমিকা নেয়ার কথা থাকলেও সার্বিক পরিস্থিতিতে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। স¤প্রতি ছাত্র-জনতা হত্যা করায় ‘কটু কথা’র ভয়ে পুলিশ সাধারণ মানুষ থেকে কিছুটা দূরে থাকতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের সবাইতো আর অন্যায় করেনি। যারা অন্যায় করেছে তাদের চিহ্নিত করব, তাদের শাস্তি হবে। বাকিরা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু এটি একটি লম্বা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সীমিত সময়ের জন্য সেনা কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব মর্যাদার কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে প্রজ্ঞাপন দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সারাদেশে ৬০ দিনের জন্য এই ক্ষমতা পান তারা। পরবর্তী সময়ে ৩০ সেপ্টেম্বর এই প্রজ্ঞাপনে সংশোধন এনে ‘সশস্ত্র বাহিনী’ করা হয়। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌ ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনীকে যে সময়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তার মধ্যেই পুলিশ ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা প্রকাশ করেন ড. ইউনূস।
গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব ও সরকার পরিচালনায় তরুণদের ভূমিকা বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, তরুণদের হাতেই ক্ষমতা যাওয়া উচিত। এখানে বুড়োদের কোনো কাজ নেই। তারা শুধু ভুল করে গেছে এ পর্যন্ত। তিনি বলেন, তরুণদের নেতৃত্বে একটি বড় কাণ্ড হয়ে গেল। কাজেই তাদের অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আমি বরাবরই বলে আসছি, তরুণদেরই দেশ চালানো উচিত। তারাই তাদের ভবিষ্যৎ রচনা করবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই তরুণদের হাতে দায়িত্ব দিয়ে দেয়া ভালো।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দুই দেশেরই স্বার্থ হলো অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা। মাঝেমধ্যে কতগুলো প্রশ্ন এসে যায় যেখানে সম্পর্কে একটু চির ধরে। যেমন সীমান্তে গুলি করল, বাচ্চা মেয়ে মারা গেল, বাচ্চা ছেলে মারা গেল, এগুলো মনে কষ্ট দেয়। এটাতে আমরা মনে করি না- সরকার ইচ্ছা করে, ভারতের সরকার ইচ্ছা করে এসব করেছে। যে সমস্ত কারণে এসব ঘটে, সেসব কারণ যেন আমরা উৎখাত করতে পারি, যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, যাতে নিরাপদে মানুষ জীবন নিয়ে চলাফেরা করতে পারে।
ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, এটা আইনগত বিষয়। তিনি যেখানেই থাকুন, নিশ্চই আমরা তাকে ফেরত চাইব আইনি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, এই বৈঠক হয়েছে সার্কভুক্ত একটি দেশ হিসেবে। তার মানে এই নয় যে, সবকিছু পাল্টে গেছে। একাত্তরে গণহত্যার বিষয়ে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সেটা পৃথক বিষয়। এটা কীভাবে হবে সেটা পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা হবে। কিন্তু সার্ক একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা চাই, এটা শক্তিশালী হোক ও সেই চেষ্টা আমি করে যাব।
গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা এবং পুলিশ নিহত ও আহতের ঘটনায় সরকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে যেখানে অপরাধ করেছে, সে তার শাস্তি পাবে। একটার বিচার হবে, আরেকটার হবে না, এটার বিরুদ্ধেই তো গণঅভ্যুত্থান হলো। কাজেই অপরাধ করলেই তার শাস্তি পেতে হবে।
পাহাড়ে সা¤প্রতিক অস্থিরতা নিয়ে বর্তমান সরকার বিশেষভাবে চিন্তিত কিনা জানতে চাইলে শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমরা সব জায়গায় শান্তি চাই। কোনো কোনো জায়গায় হয়তো অপারগ হয়েছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা ইচ্ছা করে এটা করছি না। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা বিঘিœত হয়েছিল, সেটা ঠিকও হয়ে গেছে। এমন ঘটনা ঘটলে সরকারের দায়িত্ব তা সমাধান করা। মানুষের মধ্যে সৌহার্দ নিয়ে আসা। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এত বছরের একটা সমস্যা এত অল্প সময়ের একটি সরকার সমাধান করে ফেলবে, এটা আশা করা ঠিক হবে না। বহু বছরের চেষ্টায় শান্তি চুক্তি হয়েছে। সেটাও মানছে না। আবার নতুন করে শান্তিচুক্তি করতে হবে কিনা, সেটা দেখতে হবে। আমাদের সরকার সেটা পেরে উঠবে না। পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার এসে এটা করবে।
রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দেয়া বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, তাদের শরণার্থী মর্যাদা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দিয়েছে। ইউএনএইচসি সেখানে কাজ করছে। নতুন করে রোহিঙ্গা আসতে চাইলে বাংলাদেশ তাদের গ্রহণ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। আন্তর্জাতিক আইন আছে। সেই অনুযায়ী সবাই মিলে এটা দেখা হবে। যখন কারো জীবন শঙ্কা দেখা দেয় তখন সে অন্য দেশে আশ্রয় চায়। তারা আসতে চাইছে আর আমরা দরজা বন্ধ করে দেব, সেটা হবে না। এটা আইনবিরুদ্ধ কাজ। জাতিসংঘের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বৈঠকগুলোতে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, আগের সরকার সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সেখান থেকে পুনর্জাগরণ করতে হবে। এর জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা কমিশন গঠন করছি। ছয়টি করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি সংবিধান নিয়ে। আরো কমিশন আসছে। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে সারাদেশ একমত উল্লেখ করে তিনি বলেন, কী বিষয়ে বা কীভাবে হবে, সেটা নিয়ে বিতর্ক হবে। কমিশন একটা রূপরেখা দেবে, সেটা নিয়ে সারাদেশে বিতর্ক করার সুযোগ তৈরি করা হবে, যেন রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে এবং সবাই মিলে ঠিক করে যে এই সংশোধন এখনই করবে না কি পরবর্তী সময়ে করবে। তবে যে সংবিধান আমাদের আছে, এটা দিয়ে দেশ চলবে না। চললে আবারো একই ঘটনার সৃষ্টি হবে। সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা আইনি ব্যাপার। আমরা এখন কাজ করছি কী দরকার সেটা নিয়ে। আইনসঙ্গতভাবে কীভাবে সেটা হবে তা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীরা এখন দেশের রাজনীতিতে সামনের দিকে চলে আসছে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, আমাদের সংবিধান বলে, প্রত্যেকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সেই অধিকার আমার নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানের বিধান থেকে আমি বের হয়ে আসতে পারি না। তারা যদি অপরাধ করে তাহলে শাস্তি পাবে। কিন্তু রাগ করে তাকে দুশমন ভাবতে পারি না, তার অধিকার কেড়ে নিতে পারি না। এটা কোনো রাষ্ট্র করতে পারে না, করলে সেটা অচল রাষ্ট্র হবে। বর্তমান সরকারের মূল লক্ষ্য সংস্কারের পর নির্বাচন দেয়া এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।