শাফিন : মাইলস টু গো
কণ্ঠ আর গিটারের রাজা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
ব্যান্ডসংগীতের অন্যতম নাম শাফিন আহমেদ। তার ব্যান্ড মাইলস দেশের শ্রোতাকে নতুন ধারার বাংলা সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেই মুগ্ধতা আজো অটুট। তাই তো ৪০ পেরিয়েও মাইলস এখনো নিজের গতিতে পথ হাঁটছে। সেই মাইলসের নব্বই ভাগ গানের শিল্পী শাফিন আহমেদের জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। তারা তিন ভাই- তাহসিন, হামিন ও শাফিন। বাবা কমল দাশগুপ্ত, মা ফিরোজা বেগম। দুজনেই সংগীতাঙ্গনের কিংবদন্তি। তবে অনেকেই জানেন না, ছেলেবেলায় শাফিন আহমেদের নাম ছিল মনোজিৎ দাশগুপ্ত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৬৭ সালের দিকে গোটা পরিবারসহ পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন তারা।
এরপর ভর্তি হন স্কুলে। সে সময়ই পরিবর্তন করা হয় তার নাম। মনোজিৎ দাশগুপ্ত থেকে তিনি হয়ে যান শাফিন আহমেদ। এক সাক্ষাৎকারে সেই গল্প জানিয়েছিলেন শাফিন। তার কথায়, জন্ম যেহেতু কলকাতায়, আমরা জানি যে, ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হলো, তখন হিন্দু-মুসলিমের মাঝে যে দূরত্ব বা বিবাদ, সেই সময়ে তা প্রবল ছিল। সেখান থেকেই কিন্তু দুটি দেশের জন্ম- ভারত ও পাকিস্তানের। ভারতে থাকাকালীন অবস্থায় সম্পূর্ণভাবে যে সে একজন ভারতীয় নাগরিক সেজন্য হিন্দু পরিচিতিটা যে রকম প্রয়োজন ছিল, একই রকমভাবে যখন পূর্ব পাকিস্তানে চলে এলাম তখন দেখা গেল মুসলিম পরিচয়টা খুব জরুরি ছিল। কারণ আমরা স্কুলে ভর্তি হতে পারছিলাম না।
সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের বাসার ব্যাপারটা ছিল কি, বাবা খুবই প্রগ্রেসিভ একজন মানুষ ছিলেন। ধর্ম নিয়ে তার মধ্যে সে রকম কোনো চিন্তা-ভাবনা ছিল না। তিনি গানের জগতের মানুষ, গান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমরা ছোটকাল থেকে বড় হয়েছি আসলে ইসলাম ধর্মকে ঘিরেই। মায়ের কাছ থেকেই এই প্রভাব এসেছে। ইসলাম ধর্মের চর্চাটা বাসায় ছিল। এ ব্যাপারে বাবার কোনো মন্তব্য ছিল না। তার কোনো দৃষ্টিভঙ্গি কখনই তিনি চাপিয়ে দিতে চাননি। ফলে ওখানে (কলকাতা) থাকার সময়ে স্কুলে পড়তে গেলে স্বাভাবিকভাবে কমল দাশগুপ্তের মতো একজন সংগীত ব্যক্তিত্বের সন্তান তো দাশগুপ্ত নামেই পরিচিত হবে। এটাই স্বাভাবিক। এটা দাশগুপ্তের কথা বললাম, আর প্রথম অংশ এসেছে বাবা-মায়ের দেয়া নাম থেকেই। সেভাবেই মনোজিৎ দাশগুপ্ত।’
শাফিন আহমেদের ডাক নাম ছিল মুনা। সেই বিষয়টি নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘আমার ডাকনাম ছিল মুনা। পরিবারের মধ্যে অনেকে এ নামেই ডাকে। এছাড়া সংগীতাঙ্গনের অনেকে যারা আমাকে ছোটবেলা থেকে চেনে, তখনো এমন তারকাখ্যাতি পাইনি, বয়স ১৭-১৮ হবে; সেই সময়ে যারা চিনতেন তারাও মুনা নামটিই আগে বলেন।’
বাবা কমল দাশগুপ্তের কাছে তিনি যেমন উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছেন, আবার মায়ের কাছে শিখেছেন নজরুলসংগীত। এরপর বিদেশে পড়াশোনার কারণে পাশ্চাত্যের সংস্পর্শে ব্যান্ডসংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন শাফিন। ১৯৭৯ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস। এর কিছুদিন পর এতে যুক্ত হন দুই ভাই- শাফিন ও হামিন। এরপর ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘জ¦ালা জ¦ালা’, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘জন্মদিন’সহ বহু শ্রোতানন্দিত গান উপহার দেন তারা। ব্যান্ডের বাইরেও শাফিনের জনপ্রিয় অসংখ্য গান রয়েছে। মাইলসের প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম ‘প্রতিশ্রæতি’ প্রকাশ হয় ১৯৯১ সালে। তার আগে প্রকাশিত হয় দুটি ইংরেজি গানের অ্যালবাম ‘মাইলস’ ও ‘এ স্টেপ ফারদার’।
একটা সময় বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে পণ্ডিতরা তাদের সারা জীবন লাগিয়ে দিতেন যোগ্য শিষ্য তৈরি করতে। নিজের সংগীত ধারা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা পরের প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গুরুদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। তবে এখন গান বাণিজ্যিক উপকরণ হয়ে পড়ায় সবাই শুধু নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত। খুব কম শিল্পী আছেন যারা পরের প্রজন্মের কথা ভাবেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন শাফিন আহমেদ। নতুন প্রজন্মের মেধাবী শিল্পীদের গানের জগতে আত্মপ্রকাশ করার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডাবল বেইজ প্রোডাকশন হাউস। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মেধাবী নতুন শিল্পীদের গান প্রকাশ করছিলেন নিয়মিত।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘নিয়মিত নতুন শিল্পীদের গান আসছে আমার প্রডাকশন হাউস থেকে। ডাবল বেইজ ইউটিউব চ্যানেলে আসছে ভিডিও ভার্সন। আর অডিও ভার্সন আসছে বিভিন্ন স্ট্রিমিং অ্যাপে।’ বাংলা র্যাপ গানকেও প্রমোট করতে দেখা গেছে তাকে। ঢাকার র্যাপার ওজির ‘গান পাউডার’ নামে একটি ইংরেজি র্যাপ গান প্রকাশ করেন নিজের প্রযোজনায়। পাবনার র্যাপার টি জেড ও ঢাকার র্যাপার বিশালের একাধিক গান প্রকাশ করেন তিনি।
র্যাপ গান নিয়ে এত কাজ করা প্রসঙ্গে শাফিন বলেছিলেন, ‘আমরা যখন রক গানের চর্চা শুরু করলাম তখন কিন্তু এ দেশে সেভাবে তা জনপ্রিয় ছিল না। আমরাই সেটা জনপ্রিয় করেছি। কিছুদিন আগেই মেটাল আমাদের দেশে চলত না। এখন তা বড় পরিসরে চর্চা হচ্ছে। আর এখন সময় এসেছে বাংলা র্যাপ জনপ্রিয় হওয়ার। তাই যারা এ ধাঁচের গানে মেধার পরিচয় দিচ্ছে তাদের সবার সামনে তুলে ধরতে চাইছি।’
মাইলস নিয়ে বড় পরিকল্পনা ছিল শাফিন আহমেদের। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়েছে মাইলসের কিছু মিউজিক ভিডিও গান করা দরকার। বড় পরিসরে কাজগুলো করব।’ তবে এই কথা বলার কিছুদিন পরেই ২০২১ সালের শেষের দিকে অন্তঃকোন্দলের কারণে মাইলস ছেড়ে একক সংগীত ক্যারিয়ারে মনোনিবেশ করেন শাফিন। মাইলসের বাইরের মিউজিশিয়ান নিয়ে নিয়মিত দেশে-বিদেশে বড় বড় কনসার্টে গাইতেন তিনি। পাশাপাশি নিজের ইউটিউব চানেলে মিউজিক ভিডিওসহ প্রকাশ করতেন নতুন নতুন একক গান। এর মধ্যে পপ ধাঁচের ‘শূন্যতা’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
এছাড়া ভারত, ইউরোপ ও আফ্রিকান মিউজিশিয়ানদের নিয়ে ভারতীয় রাগের ওপর একটি ব্লæজ-ফিউশন যন্ত্রসংগীতের ভিডিও প্রকাশ করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। চ্যানেল আইয়ের জন্য ‘পিয়ানো রাউন্ড’ নামের একটি অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র পিয়ানোর ওপর বেইজ করে জনপ্রিয় গানের নতুন কম্পোজিশন করেছিলেন সম্প্রতি। সেই গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনিসহ দেশের জনপ্রিয় শিল্পীরা। বাবা উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ কমল দাশগুপ্তর গানেরও নতুন সংগীতায়োজন করেছিলেন। এই গানগুলো দর্শকের কাছে নতুনভাবে ফিরিয়ে আনেন শাফিন।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে সলো কনসার্টে অংশ নিতে গত ৯ জুলাই বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে উড়াল দেন এই ব্যান্ড তারকা। এর মধ্যে একটি কনসার্টে গানও পরিবেশন করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় কনসার্টের আগ মুহূর্তে মঞ্চে আর ওঠা হলো না তার। ২০ জুলাই ভার্জিনিয়াতে তার দ্বিতীয় স্টেজ শোতে পারফর্ম করার কথা ছিল। সেদিন অনুষ্ঠানের আগে হোটেল রুমে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। সেখানেই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল শাফিন আহমেদের।
অবশেষে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় ভোর ৬টা ৫০ মিনিটে তিনি জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যান। তাকে ফেরানো গেলনা কিন্তু শ্রোতাদের ভালোবাসা নিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।