ব্যাংক ঋণের বন্ধকি সম্পত্তি ইসকনকে দান করে ভারতে আত্মগোপন

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১২ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ব্যাংক থেকে প্রায় ১১৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি ইসকনকে উইল (সম্প্রদান) করে ভারতে আত্মগোপন করেছে এক ব্যবসায়ী দম্পতি। তারা হলেন নওগাঁর জেএন ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এবং শুভ ফিড প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোপাল আগরওয়ালা ও চেয়ারম্যান দীপা আগরওয়ালা। ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের জমি বন্ধক রেখে এই ঋণ দিয়েছিল বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের নওগাঁ শাখা। বর্তমানে যা অনাদায়ি এই ঋণ সুদে-আসলে ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের নওগাঁ শাখায় এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামের হিসাবে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বেশ কিছু সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের একটি অংশ পাচার হয়েছে বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, ব্যাংকে বন্ধক রাখা সম্পত্তি উইল করে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি সরাসরি আইনের লঙ্ঘন। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শাস্তি দেয়া হবে।
আইনজীবীরা বলছেন, বন্ধকি সম্পত্তি থেকে ঋণ সমন্বয়ের আইনি অধিকার ব্যাংকের রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোজাহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ঋণের বিপরীতে রাখা বন্ধকি সম্পত্তি উইল করা বেআইনি। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩(ডি) ধারা অনুযায়ী, ব্যাংকের লিখিত অনুমতি ছাড়া বন্ধকি সম্পত্তি হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংক বন্ধকি সম্পত্তি থেকে ঋণ সমন্বয় করবে, এটিই নিয়ম।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ৫ মার্চ গোপাল আগরওয়ালা ও দীপা আগরওয়ালা দম্পতি তাদের প্রতিষ্ঠান জেএন ইন্ডাস্ট্রির নামে সাউথইস্ট ব্যাংকের নওগাঁ শাখায় একটি চলতি হিসাব খোলেন। ওই হিসাবে ব্যাংকটির নোয়াখালীর চৌমুহনী ও ফেনী শাখা থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ জমা হয় এবং গ্রাহক পরের কার্যদিবসে ওই টাকা তুলে ফেলেন। একইভাবে ২০১৮ সালের ৩০ মে এবং ১১ জুলাই যথাক্রমে ১৫ লাখ ৬০ হাজার এবং ২৬ লাখ টাকা চেক দিয়ে তোলা হয়। একই বছরের ২ এপ্রিল ওই হিসাবে গ্রাহকের মেয়াদি ঋণ থেকে ১৫ কোটি টাকা স্থানান্তর করে সেদিনই চারটি চেকের মাধ্যমে টাকা তুলে নেন গ্রাহক। এভাবে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ওই হিসাবে টাকা স্থানান্তর এবং চেক দিয়ে টাকা তোলা হয়। একই প্রতিষ্ঠানের নামে সাউথইস্ট ব্যাংকের ঢাকার শ্যামলী শাখা থেকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে ওই ঋণপত্রের বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেনি ব্যাংকটি। পরিদর্শক দল বিষয়টিকে অসংগতি বলে উল্লেখ করে এবং ঋণপত্রের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ পোষণ করে।
আরো পড়ুন: স্বর্ণের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, মূল কারণ কি?
প্রতিবেদনে বলা হয়, জেএন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ২০১৬ সালের ৯ জুন ৭৫ কোটি টাকা চলতি ঋণের (সিসি) আবেদন করে। সেদিনই শাখা থেকে ওই গ্রাহকের ৬০ কোটি টাকার ওভারড্রাফট ও ১০ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ অনুমোদনের জন্য ব্যাংকটির করপোরেট ব্যাংকিং ডিভিশনে পাঠানো হয়। এতে গ্রাহকের নামে থাকা মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নওগাঁ শাখায় ৪০ কোটি টাকার সিসি ও ৫ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ অধিগ্রহণের জন্য ৬০ কোটি টাকার ওভারড্রাফটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণসীমা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। ওই আবেদনের অনুকূলে সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় একই বছরের ২১ জুলাই অভ্যন্তরীণ ঋণসীমাসহ ৫০ কোটি টাকার ওভারড্রাফট ও ১০ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ অনুমোদন করে। প্রধান কার্যালয় থেকে ১ সেপ্টেম্বর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নওগাঁ শাখায় গ্রাহকের নামে থাকা ৪৫ কোটি টাকার সিসি ও ৮ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এই ঋণের জামানত হিসেবে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় গোপাল আগরওয়ালার মালিকানাধীন ৪৩৪ শতাংশ জমি বন্ধকের শর্ত দেওয়া হয়। জরিপ ও মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই সম্পত্তির মোট মূল্য ৬০ কোটি ৫১ লাখ টাকা এবং তাৎক্ষণিক বিক্রয়মূল্য ৪৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জে এন ইন্ডাস্ট্রিজ ও শুভ ফিড প্রসেসিংয়ের নামে বিভিন্ন সময়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের নওগাঁ শাখা থেকে আরো ৫৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। তবে এই ব্যবসায়ী দম্পতি ঋণ পরিশোধ না করেই ২০১৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়।
সাউথইস্ট ব্যাংকের নওগাঁ শাখা এবং প্রধান কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জেএন ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এবং শুভ ফিড প্রসেসিংয়ের এমডি গোপাল ও চেয়ারম্যান দীপা আগরওয়ালা কৌশলে ব্যাংকে বন্ধকি সম্পত্তি ইসকনের নামে উইল করে দেশত্যাগ করেছেন। বর্তমানে সেই ঋণ খেলাপি এবং সুদাসলসহ অনাদায়ী পাওনা ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এখন সরকার বদলের পর এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই জানে।
আরো পড়ুন: নতুন উচ্চতায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক, বলিষ্ঠ হচ্ছে যোগাযোগ বাণিজ্য
জানতে চাইলে সাউথইস্ট ব্যাংকের নওগাঁ শাখার ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বলেন, ‘গোপাল আগরওয়ালা দম্পতির প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণ এবং প্রশ্নবিদ্ধ লেনদেনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ ওই ঋণ খেলাপি কি না এবং স্থিতি কত, জানতে চাইলে তিনি গ্রাহকের সব তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বন্ধকি সম্পত্তি ইসকনকে উইল করে দেয়ায় কীভাবে এই ঋণ সমন্বয় হবে জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
ওই ঋণের সামগ্রিক বিষয়ে জানতে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুদ্দীন মো. সাদেক হোসাইনকে বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) কয়েকবার মোবাইলে কল করা হলে তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে সাউথইস্ট ব্যাংকের শ্যামলী শাখার ২০১৭ সালের ১২ মার্চ নিষ্পত্তি করা ঋণপত্রের বিপরীতে ৬ লাখ ৭৫ হাজার মার্কিন ডলারের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ট্রাকের রসিদ ও কমার্শিয়াল ইনভয়েসের তথ্য অনুযায়ী, পণ্য সরবরাহকারীর ঠিকানা ভারতের কোলকাতা; কিন্তু ঋণপত্রের অর্থ পাঠানো হয় মুম্বাইয়ে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ওভারড্রাফট বা ওডি করে ৪৭ কোটি টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নওগাঁ শাখায় গোপাল আগরওয়ালা দম্পতির প্রতিষ্ঠানের চলতি ঋণ পরিশোধ করা হয়। ২০১৭ সালের ২ জুলাই গ্রাহকের নামে মেয়াদি ঋণ খুলে ১০ কোটি টাকা দিয়ে ওডি হিসাবের কিছু দায় সমন্বয় করা হয়। ওই ব্যাংকে আগরওয়ালা দম্পতির প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু লেনদেনকে সন্দেহজনক বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নওগাঁ শাখার ব্যবস্থাপক মিল্টন বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে বলেন, সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে তার জানা নেই। তবে ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, গোপাল আগরওয়ালা দম্পতির ওই দুই প্রতিষ্ঠানের হিসাব নম্বরে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে বিএফআইইউ নওগাঁ শাখা পরিদর্শন করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১২-১৯ সাল পর্যন্ত সাউথইস্ট ব্যাংকের নওগাঁ শাখায় আগরওয়ালা দম্পতির প্রতিষ্ঠানের হিসাবে মোট জমা ও উত্তোলনের পরিমাণ যথাক্রমে ৪৩ কোটি ৩৪ লাখ এবং ৪৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০২০ সালে বিএফআইইউর পরিদর্শনের সময় ওই হিসাব দীর্ঘ সময় লেনদেনহীন (ডরম্যান্ট) দেখা যায়।