এনজিওর জালে আটকা জেলেজীবন
দুবলারচর এখনো সাহেবদের কব্জায়

কামরুজ্জামান খান, দুবলারচর থেকে ফিরে
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০২ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
বঙ্গোপসাগরের তীরে দুবলারচরে এখন শুটকির ভরা মৌসুম চলছে। কয়েক হাজার মৎস্যজীবীদের পদচারণায় মুখরিত দুবলারচরে পুরোদমে শুরু হয়েছে সাগর থেকে মাছ ধরে শুঁটকিকরণ প্রক্রিয়া। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ১০ হাজার জেলে মাছ ধরা ও শুকানোর কাজে নেমে পড়েছেন। পাঁচ মাস ধরে তারা কাজ করেন এই চরে। প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও শুটকি শিল্পে নেই সরকারি কোনো বড় উদ্যোগ। অস্থায়ী ঘর ও মাচা করতে হয় মহাজন ও জেলেদের উদ্যোগে।
বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে মহাজনেরা দুবলারচরে ব্যবসা করলেও ‘সাহেবদের’ তারা আশীর্বাদ মনে করেন। সাহেবরা বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে কাঁচা চিংড়িমাছ (হেডলেস চিংড়ি) সংগ্রহ করেন। তারাই মূলত বন বিভাগ থেকে সাগরে জেলেদের মাছ ধরার অনুমতির ব্যবস্থা করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। এজন্য মহাজন ও জেলেরা তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। এনজিওর দাদন ও সাহেবদের বিনিয়োগ শুধিয়ে মৌসুম শেষে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না শুটকি শিল্পে জড়িতরা।
সরজমিনে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে জেলেরা বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের সংলগ্ন নদী থেকে ধরে এনে প্রচুর পরিমাণে মাছ শুটকি বানায়। রূপচাঁদা, লইট্যা, ছুরি খলিসাসহ প্রায় ৮৫ প্রজাতির মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের চিংড়ি সুন্দরবনে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। সুন্দরবনের দুবলারচর, চাপড়া খালিস, আলোরকোল, মেহের আলী, মাঝির কিল্লা, শেওলার চর, কোকিলমনি, কবরখালী, নারকেল বাড়িয়া, বড় আম্বেরিয়া, মানিক খালি ও ছোট আম্বেরিয়ায় এলাকায় মাছ শুটকি করা হয়। চরে জেলেদের থাকার জন্য বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে আলোরকোলে ৮২৫টি, মাঝেরকেল্লায় ৪০টি, নারিকেলবাড়ীয়ায় ৯৫টি এবং শ্যালারচরে ৭৫টি অস্থায়ী জেলেঘর নির্মাণ করেছে। ছন দিয়ে এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া আলোরকোলে ৯০টি দোকান, ৫১টি মাছের ডিপো, মাঝেরকেল্লায় দুইটি দোকান, পাঁচটি মাছের ডিপো, নারিকেলবাড়ীয়ায় দুইটি দোকান, চারটি ডিপো এবং শ্যালারচরে দুইটি দোকান ও চারটি মাছের ডিপো বসানো হয়েছে। সাগরতীরে জেলেদের অস্থায়ী থাকার ঘর, মাছ শুকানোর চাতাল এবং মাচা বানাতে সুন্দরবনের কোনো গাছপালা ব্যবহার না করার জন্য বনবিভাগের নির্দেশনা আছে। এসব বানাতে জেলেরা গ্রামের গাছপালা সঙ্গে নিয়ে গেছেন।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করলো নেপাল

সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন জেচলার মানুষ সেখানে বছরে পাঁচমাস কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই পাঁচমাসের আয়-রোজগারের টাকায় চলে তাদের সারা বছরের হিসেব। চরের পাঁচমাস (নভেম্বর-মার্চ) সময়কালে তারা দুই-একমাস পর ৪-৭ দিনের জন্য ছুটিতে বাড়িতে পরিবারের কাছে যাওয়ার সুযোগ পান। প্রায় ২ হাজার ট্রলার ও নৌকা নিয়ে এখানে আগত জেলেরা নভেম্বর থেকে মার্চ এই পাঁচমাস সাগরে মাছ ধরেন। ধরে আনা মাছ জেলেরা মাচায় শুকিয়ে শুঁটকি করেন।
বাগেরহাট রামপালের বাসিন্দা ইমরান ফরাজী (৩৭) শুটকি মাছ ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তার বাবা কুদ্দুস ফরাজী ৫০ বছর আগে এই চরে শুটকি ব্যবসা করেছেন। তার অপর ভাই মুতাচ্ছিন ফরাজীও এই ব্যবসায় জড়িত। ইমরান জানান, এই খাত থেকে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব পেলেও নেই পৃষ্ঠপোষকতা। ব্যবসায়ীরা এনজিওর থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এই ব্যবসা করে আসছে। তিনি বলেন, মূলত সাহেবরা বনবিভাগ থেকে তাদের মাছ ধরার অনুমতির ব্যবস্থা করে থাকেন। তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন জেলে-মহাজনদের কাছে। সাহেবরা-কোনো সুদ না দিলেও বিনিয়োগের বিপরীতে কাঁচা চিংড়িমাছ নিয়ে থাকেন। এসব চিংড়ি ‘হেডলেস চিংড়ি’ হিসেবে পরিচিতি। চিংড়ি মাছ ধরার পর মাথা কেটে রাখা হয়। সাহেবরা এসব মাছ ১২-২৫ হাজার টাকা মণ দাম ধরে কিনে থাকেন মহাজন/জেলেদের কাছ থেকে। তারা সেগুলো বিভিন্ন কোম্পানীর কাছে বিক্রি করেন। যা পরে বিদেশে রপ্তানি হয়ে থাকে।
ইমরান আরো জানান, কামাল উদ্দিন, খুলনার পিন্টু কমিশনার, খোকন, হক, হাকিম বিশ্বাস, জাহিদুল সাহেব- তাদের ওখানে বিনিয়োগ করেন। সাহেবরা বিনিয়োগ করলেও সেই টাকা পর্যাপ্ত না হওয়ায় মহাজনেরা এনজিও থেকে প্রতি লাখে শতকরা ১৪ টাকা হারে সুদে টাকা নেয়। এছাড়া পাঁচমাসের জন্য এক লাখ টাকা নিয়ে বাড়তি ২০ হাজার টাকা সুদ গুনতে হয়। তবে অর্থ বিনিয়োগ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কারণে তারা সাহেবদের আশীর্বাদ মনে করেন। ইমরান জানান, র্যাব ও কোষ্টগার্ডের তদারকি এবং নজরদারির কারণে দুবলারচরে অপরাধ করার সুযোগ পায় না কেউ।
রামপাল মৎস্যজীবি সমবায় সমিতির সভাপতি মুতাচ্ছিন ফরাজী জানান, এলাকায় এনজিও থেকে নেয়া ঋণের টাকায় তারা ব্যবসা করেন। দাদন নেন। দুর্যোগের সময় দুবলারচরে আশ্রয়ের জন্য যে শেল্টারহোম রয়েছে তা চর থেকে অনেক দূরে। ঝড়ের পূর্বাভাস পেলে সেখানে ১০ হাজার জেলে যাওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু চরে লোক থাকে ৫০ হাজার। বাকিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চরেই থাকেন।
আরো পড়ুন: সংকট নিরসনে সংস্কার কার্যক্রম চলছে : ড. সালেহউদ্দিন

তিনি বলেন, সাগরে বিষাক্ত সাপ আছে। সাপ কাউকে কামড় দিলে তিনি বড়জোড় ২০ মিনিট বাঁচেন। কোনো চিকিৎসা কেন্দ্র না থাকায় প্রতিবছর বিনা চিকিৎসায় সাপে কাটা অনেক রোগী মারা যায়। মাছ শুকানোর কাজে নিয়োজিত লোকমান হোসেন (৭০) জানান, একটি নৌকা তৈরীতে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতি নৌকার জন্য ১০ জন করে শ্রমিক আনা হয়। মাছ ধরার জেলেরা মাসে ১০ হাজার এবং শুকানোর কাজ করেন তারা মাসে ৫ হাজার টাকা করে পান। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন মহাজন। অনেকে মাস হিসেবে আবার অনেকে মৌসুম হিসেবে মজুরি নেয়।
রতন মন্ডল মন্ডল (২৪) জানান, তার বাড়ি বাগেরহাটের রামপালে। চরে বড় বাজার আছে, সকাল থেকে গভীররাত পর্যন্ত সেটি খোলা থাকে। সেখানে নিত্যপন্য বিক্রি হয়। সাড়ে ৩ হাজার ঘরে ৪০-৫০ হাজার মানুষ থাকে এবং কাজ করেন। মুজাহিদ (১৫) নামে একজন বলেন, সেখানে শুধুমাত্র টেলিটক মোবাইল ফোন সচল। রাতে সৌর বিদ্যুৎতের আলো তাদের ভরসা। মুর্শিদ (১৭) জানান, মহাজন ছাড়া কেউ কোনো শুটকি বিক্রি করেন না। এখানে কোনো নারী শ্রমিক নেই বলেও জানান তিনি। সোহেল (২৮) নামে এক জেলে জানান, এখানকার শুটকির নিজস্ব বাজার রয়েছে। অনেক শুটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তারপরও পর্যটকরা গেলে তাদের কাছে শুটকি মাছ বিক্রি করা হয়। রহিম উদ্দিন (৬৫) জানান, কার্তিক, অগ্রায়ন, পৌষ, মাঘ, ফাগুন ও চৈত্র মাস মিলে দুবলার চরে কাজ চললেও মূলত ঘর ও মাচা নির্মাণে অনেকটা সময় চলে যায়। এরপর মাছ ধরে শুকানোর কাজ চলে। বছরে মূলত পাঁচমাস তাদের কাজের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। তিনি জানান, সূর্যোদয়ের আগেই তারা মাছগুলোকে জাল থেকে বের করেন এবং শুটকি হিসেবে প্রক্রিয়াজাত করতে রোদে শুকাতে দেন। সোলেমান মিয়া (৫২) জানান, সাতক্ষীরা, খুলনা, পিরোজপুর, বরগুনা ও বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার হাজার-হাজার জেলে মাছ শুকানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য এখানে অস্থায়ী ঘর তৈরি করেন। তিনি জানান, অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় বেশি মাছ পাওয়া যায়। শুটকিগুলো সরাসরি কুয়াকাটা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠানো হয়।
চরের জেলেরা বলেছেন, বনবিভাগের কাছে সাহেব হিসেবে আফিয়া বেগম, খান শাফিউল্লাহ, শেখ মইনুদ্দিন আহমেদ, আরিফ হোসেন, রেজাউল শেখ, এ বি এম মুস্তাকিন, ইদ্রিস আলী, জালাল উদ্দিন আহমেদ, সুলতান মাহমুদ, বেলায়েত সরদার, কামরুর নাহার, শাহানুর রহমান ও আসাদুর রহমান সরদারের নামও পরিচিত। তারাও জেলেদের জন্য ‘পাস’ ব্যবস্থা করেন। মোংলা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে দুবলার চর মৎস্য গ্রামে মাছ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের জন্য ১৩টি কেন্দ্র রয়েছে। মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ ও বিক্রির জন্য মৎস্যজীবী ও ডিপোর মালিকরা ওখানে যান। এ বছর ৯৮৫টি বাড়ি, ৫৭টি ডিপো ও ৯৩টি দোকান স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে বন বিভাগ।