পোশাক শ্রমিকদের ১৮ দাবি পূরণ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি : ভোরের কাগজ
পোশাক খাতের শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার ও মালিকপক্ষ। এতে সব পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিদ্যমান হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়বে। সেই সঙ্গে অক্টোবর মাসের মধ্যে সব কারখানায় সরকার ঘোষিত নি¤œতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া ১০ অক্টোবরের মধ্যে শ্রমিকদের সব বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে হবে কারখানা কর্তৃপক্ষকে। শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে মালিকপক্ষও। ১৮টি দাবির সবই মেনে নিতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আজ বুধবার থেকে সব কারখানা চালু রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। এ সময় বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করা হলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
সচিবালয়ে গতকাল মঙ্গলবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছি। এ সমঝোতা স্মারকে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষ সবাই স্বাক্ষর করেছে। সবাইকে এটা মেনে চলতে হবে, সবাইকে এই অঙ্গীকার করতে হবে। এই চুক্তি থেকে আমাদের পিছু হটার কোনো কারণ বা অবকাশ নেই। কোনো বাহানা করা যাবে না। ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবং যুব ও ক্রীড়া এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ পোশাক কারখানার মালিক ও শ্রমিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, কারখানায় উৎপাদনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে শ্রমিকদের হাজিরা বোনাস, টিফিন ও রাত্রিকালীন ভাতা ১০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন পোশাক কারখানা মালিকরা। শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানান, শ্রমিকদের দাবি মেনে নেয়ায় আজ বুধবার থেকে শিল্পাঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের সব কারখানা আজ থেকে সচল দেখতে চান বলেও উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা মাধ্যমে এই শিল্পটিকে নষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু দেশ থেকে নয় বিদেশ থেকেও হচ্ছে। এই শিল্প যদি বাইরে চলে যায় তাহলে আমাদের কী হবে। সে বিষয়টা সবাইকে চিন্তা করতে হবে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনো অবস্থাতেই আপনারা নিজেদের হাতে নেবেন না।
১৮ দফার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সিদ্ধান্ত : সব পোশাক শিল্পকারখানায় শ্রমিকের বিদ্যমান হাজিরা বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত ২২৫ টাকা, রাত ৮টার পর বিদ্যমান টিফিন বিলের সঙ্গে ১০ টাকা এবং বিদ্যমান নাইট বিল ১০ টাকা বাড়িয়ে ন্যূনতম ১০০ টাকা করা হবে। আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে সব কারখানায় সরকার ঘোষিত নি¤œতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। আপাতত শ্রমঘন এলাকায় টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা হবে। এছাড়া, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিকেও শ্রমঘন এলাকায় স¤প্রসারিত করা হবে। শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী রেশন ব্যবস্থার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে। আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে শ্রমিকের সব বকেয়া মজুরি দিতে হবে। অন্যথায় শ্রম আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিজিএমইএ থেকে বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং করে শ্রমিকদের হয়রানির বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে একটি টেকনিক্যাল টিম পর্যালোচনা করে অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। ঝুট ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, চাঁদাবাজি বন্ধসহ শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনায় এ বিষয়ে একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ২০২৩ সালের মজুরি আন্দোলনসহ এর আগে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের হয়রানিমূলক এবং রাজনৈতিক মামলাগুলো রিভিউ করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। মজুরি আন্দোলনে নিহত চারজন শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাজের ধরন অনুযায়ী নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে, জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা দিতে হবে। শহীদ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সেবার জন্য শ্রমিক নেতারা একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে দাখিল করবে। প্রাপ্ত তালিকা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এ পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হবে। রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকারের উদ্দেশে ইতোমধ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গঠিত কমিটি অক্টোবর ২০২৪-এর মধ্যে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ দেবে। প্রাপ্ত সুপারিশের আলোকে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
শ্রম আইন অনুযায়ী সব কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হবে। অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ন্যূনতম মজুরি পুনর্মূল্যায়নে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের তিনজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত অতিরিক্ত সচিব (শ্রম)-এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নিম্নতম মজুরির বিধি-বিধান ছয় মাসের মধ্যে সক্ষমতা পর্যালোচনা করবে। শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) পুনরায় সংশোধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে ডিসেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে সংশোধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের সার্ভিস বেনিফিট প্রদান করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২৭ ধারাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিক উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পন্ন অন্যান্য দেশের উত্তম চর্চার আদলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ কমিটি বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করে শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সক্ষমতা ও করণীয় বিষয়ে নভেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে একটি সুপারিশ প্রদান করবে।
উল্লেখ্য, রপ্তানি বাণিজ্য আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি অবদান রাখা তৈরি পোশাক খাতে বেতন ও শ্রম অধিকারের নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রায় এক মাস ধরে আন্দোলন চলছে ঢাকার সাভার ও গাজীপুরের শিল্প এলাকার কারখানায়। মাঝে কয়েকদিন বন্ধ থাকলেও গত দুই দিন ধরে গাজীপুর ও আশুলিয়ায় আবার অনেক কারখানায় আন্দোলনে নেমেছে শ্রমিকরা। আন্দোলন বন্ধ থাকার সময়ে শতাধিক কারখানা বন্ধ ছিল বকেয়া বেতন ইস্যুতে। এদিকে মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত শিল্পাঞ্চলগুলোতে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর খবর পাওয়া যায়নি। তবে শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে বন্ধ থাকা ১৩টি কারখানা এখনো খোলেনি। অধিকাংশ কারখানার শ্রমিকরা ইতোমধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম জানিয়েছেন, কারখানা এলাকার নিরাপত্তায় শিল্প ও থানা পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবির টহল রয়েছে।