ফিলিস্তিনে কোকা–কোলার ফ্যাক্টরি: গুগল সার্চে কী জানা যাচ্ছে?
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৪, ০৪:৩৭ এএম

গাজায় কোকা–কোলার ফ্যাক্টরি। ছবি: দ্য নিউ আরব
ফিলিস্তিনে কোকা–কোলার ফ্যাক্টরি আছে বলে সেটা গুগল সার্চ করে একটি বাংলাদেশি বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। বিজ্ঞাপনটি নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। কিন্তু অনেকে এই তথ্যটুকু গুগলে সার্চ করারও সময় পাচ্ছে না। ফিলিস্তিনে কোকা-কোলার ফ্যাক্টরির প্রেক্ষাপট কী? কে বা কারা এই ফ্যাক্টরি করেছে এসব তথ্যও অনেকের অজানা।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে যে কয়টি পণ্যকে বারবার বয়কটের আহ্বান জানানো হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কোকা-কোলা। ফিলিস্তিনপন্থিদের সহানুভূতি আদায়ের জন্য কোকা-কোলার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ফিলিস্তিনে তাদের কারখানা রয়েছে। তবে অনেকের কাছে বিষয়টি অবিশ্বাস্য। তবে বিষয়টি সত্য। তবে সমস্যাটি অন্য জায়গায়।
আরো পড়ুন- কোকাকোলার সেই বিজ্ঞাপন নিয়ে যা বললেন আজহারী
অলাভজনক গণমাধ্যম সংস্থা ফেয়ার অবজারভার জানিয়েছে, ফিলিস্তিনের আতারোতে কোকা-কোলার কারখানাটি অবস্থিত। আর এই আতারোত হচ্ছে ইসরায়েলি দখলদারদের জবরদখল করা এলাকা। কোকা-কোলার ইসরায়েলি ফ্র্যাঞ্চাইজি সেন্ট্রাল বটলিং কোম্পানি (সিবিসি) অবৈধ বসতিতে তার আঞ্চলিক বিতরণ কেন্দ্রটি স্থাপন করেছে।
এই কেন্দ্রটি পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে কোম্পানির পণ্য বাজারজাত করে। কোকা-কোলার একটি ফিলিস্তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজিও রয়েছে, যার নাম এনবিসি (ন্যাশনাল বেভারেজ কোম্পানি)। আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়া কোকা-কোলা কোম্পানি ব্যবসার মোড় ঘুরাতে ২০১৬ সালে গাজা উপত্যকায় এনবিসির সঙ্গে মিলে প্রথম বোতলজাত প্ল্যান্ট উদ্বোধন করে। এখান থেকে বোতলজাত পানীয় পূর্ব জেরুজালেমের বাজারে এর পণ্য প্রবেশ করে না। সেখানে মুনাফার জন্য রাখা হয়েছে ইসরায়েলি ফ্র্যাঞ্চাইজিকে।
সিবিসির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলো ফিলিস্তিনের অন্যান্য অবৈধ বসতি থেকেও কাজ করে। এর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ‘ইসরায়েলি ওয়াইনারি তাবর ওয়াইনারি’ দখলকৃত গোলান হাইটসের মাউন্ট শিফনের কাছে দ্রাক্ষাক্ষেত্রের মালিক। সিবিসির মালিকানাধীন আরেকটি কোম্পানির জর্ডান উপত্যকার শাদমোট মেহোলায় একটি দুগ্ধ খামার রয়েছে।
আরো পড়ুন- দোকানের দেয়ালে কোকাকোলার লোগো থাকায় ভাঙচুরের ভিডিওটি কি সঠিক?
ফিলিস্তিনিদের দখল করা ভূমিতে কারখানা স্থাপনই সিবিসির একমাত্র কীর্তি নয়। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তাতে বলা হয়, ইসরায়েলে কোকা-কোলা ফ্র্যাঞ্চাইজি সেন্ট্রাল বটলিং কোম্পানি ২০১৫ সালে চরমপন্থি ইহুদিবাদী গ্রুপ ইম তির্তজুকে ১৩ হাজার ৮৫০ মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত ইহুদি সম্প্রদায়ের মুখপাত্র জিউস স্ট্যান্ডার্ডে ২০১১ সালের ২৭ মে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, ১৯৬৬ সাল থেকে কোকা-কোলা ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক। ১৯৯৭ সালে ইসরায়েল সরকার অর্থনৈতিক মিশন গত ৩০ বছর ধরে ইসরায়েলকে অব্যাহত সমর্থন এবং ইসরায়েলের আরব লীগ বয়কট মেনে চলতে অস্বীকার করার জন্য ইসরায়েল ট্রেড অ্যাওয়ার্ড ডিনারে কোকা-কোলাকে সম্মানিত করে।
ফিলিস্তিনে কি সত্যিই কোকা–কোলার ফ্যাক্টরি আছে? যা জানা যাচ্ছে
গুগলে খুঁজে জানা গেল, দ্য নিউ আরবে ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনের গাজায় আনুষ্ঠানিকভাবে কারখানা চালুর ঘোষণা দেয় কোকা–কোলা। তারও কয়েক মাস আগে থেকে অবশ্য কোম্পানিটি আংশিকভাবে কোকের বোতল তৈরির কারখানা চালু রেখেছিল সেখানে। কোকা–কোলার দাবি, গাজায় কোকা–কোলার ফ্যাক্টরি তৈরি হলে সেখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
এরপর ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে স্থানীয় ন্যাশনাল বেভারেজ কোম্পানির (এনবিসি) সঙ্গে যৌথভাবে পশ্চিম তীরের কাছে রামাল্লায় কারখানা চালু করে কোকা–কোলা। উদ্বোধনী দিনে এনবিসির চেয়ারম্যান ও ফিলিস্তিন অঞ্চলে কোকা–কোলার প্রধান জাহি খৌরি বলেন, ‘আজ এক ঐতিহাসিক দিন। কোকা–কোলার ও ফিলিস্তিনের জন্য এই দিনটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
কোকা–কোলার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও গাজায় কোকা–কোলার কারখানা পরিচালনার বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এনবিসি একটি স্বাধীন কোম্পানি। কোকা–কোলা এই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধভাবে কাজ করে। এ ছাড়া এনবিসির সঙ্গে যৌথভাবে কোকা–কোলা গাজায় স্কুল পরিচালনা, রোজায় ইফতার বিতরণ থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করে বলেও ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে।
কোকা–কোলা যেভাবে গাজায় সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল
১৯৯৭ সালে গাজায় কোকা–কোলার ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু করেন এনবিসির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জাহি খৌরি। এরপর গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি গাজায় কোকা–কোলার সঙ্গে তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। তবে তার এই ব্যবসায়িক যাত্রা মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের চলমান সংঘাতের মধ্যে তাঁকে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হয়েছে।
নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে জাহি খৌরি ধীরে ধীরে কোকা–কোলার সঙ্গে তাঁর ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন এবং চারটি বোতলজাতকরণ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি কোকা–কোলার তিনটি সরবরাহ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেন। কূটনীতিক সংস্থা মিডল ইস্ট কোয়ার্টেটের প্রধান কিটো ডি বোয়ের বলেন, ‘গাজায় তাঁর প্রভাব বর্ণনা করা কঠিন। একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জনপদে কারখানা চালু রাখা ও ব্যবসা পরিচালনা করা সহজ নয়।’
কোকা–কোলার মতো একটি বৈশ্বিক কোম্পানির করপোরেট অংশীদার জাহি খৌরি এবং এটিই এখন তার প্রধান পরিচয় হয়ে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার হাত ধরে কোকা–কোলা যেমন ফিলিস্তিন অঞ্চলে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে, তেমনি গাজায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পেরেছে।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক সংস্থা স্কল ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্যালি ওসবার্গ বলেন, ‘কোকা–কোলা এই অঞ্চলে দারুণভাবে সফল হয়েছে। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, যার হাত ধরে ফিলিস্তিন অঞ্চলে কোক তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, তিনি জাহি খৌরি।’
ইসরায়েল কি কোকাকোলার লর্ড ভলডেমর্ট?
বিষয়টি খুব একটা পরিষ্কার না। বিজ্ঞাপনটির মাধ্যমে দর্শকদের জানানো হয় যে, কোকাকোলার মূলত ফিলিস্তিনে ফ্যাক্টরি রয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য সত্যিকার অর্থেই কোম্পানিটির তা রয়েছে। মূলত গাজা উপত্যকায় কোকাকোলার একটি বোতলজাত প্ল্যান্ট রয়েছে। তবে ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান জাহি খৌরি উদ্যোগটি না নেওয়া পর্যন্ত এটিকে প্রায় অকল্পনীয় বলেই মনে করা হতো। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিলিস্তিনে ফিরে তিনি এই ফ্যাক্টরিটি স্থাপন করেন। খৌরি মূলত অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্ল্যান্টটি পরিচালনা করেছেন৷ যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে সবসময়ই ইসরায়েলি আগ্রাসনের কট্টর সমালোচক ছিলেন।
তার এই সমালোচনা এতটাই শক্ত ছিল যে, ২০১৫ সালে একটি ইসরায়েলি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ কোকাকোলার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের হুমকি দিয়েছিল। এক্ষেত্রে যুক্তি ছিল কোম্পানিটির ফিলিস্তিনি সহায়ক সংস্থা এনবিসি-এর সাথে সম্পর্ক রয়েছে। প্ল্যান্টের মালিক খৌরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বয়কট কিংবা নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনে সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন।
খৌরির সম্পর্কে কোকাকোলার ওয়েবসাইটেও তথ্য দেওয়া রয়েছে৷ এছাড়া সেখানে ন্যাশনাল বেভারেজ কোম্পানির (এনবিসি) ওভারভিউ পেজের গেলে দেখা যায়, ফিলিস্তিনে কাজ করা সাবসিডারিটি নিয়ে কোকা-কোলা বিবরণ দিয়েছে। যেখানে লেখা, এনবিসি গাজাসহ প্রায় ১ হাজার এসোসিয়েটের মাধ্যমে নানা সুবিধা প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে কোকা-কোলাও পরোক্ষভাবে ১০ হাজার ফিলিস্তিনিদের রিটেইল চ্যানেল ও ভ্যালু চেইনের মাধ্যমে সহায়তা করে।
ওয়েবসাইটে প্যালেস্টাইনের অন্যান্য অনেক এলাকার কথাও উল্লেখ করা হয় যেখানে এনবিসি কাজ করছে। সেসব জায়গার পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট নির্মাণ, স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন ও ইফতারের আয়োজন করা হয়। এবার বিজ্ঞাপনে ফিরে আসা যাক। কোম্পানিটি এর পাশাপাশি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছে।
গত রবিবার প্রকাশিত বিবৃতিতে কোকাকোলা মালয়েশিয়া বলে, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কার্যক্রমে নিয়ে 'মিথ্যা তথ্য', ভুলভাবে উপলব্ধি করা ও গুজবের উপর ভিত্তি করে বয়কটের আহ্বান করা হয়েছে। কোকাকোলা ও আমাদের স্থানীয় বোতল প্রস্তুতকারক এনবিসি ফিলিস্তিনের মার্কেটের প্রতি দীর্ঘমেয়াদে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৯৯৮ সালে উৎপাদন শুরু করে আমরা আজ এই অঞ্চলের বৃহত্তম নিয়োগদাতাদের একটি।
এক্ষেত্রে, ২০১৬ সাল পর্যন্ত কোকা-কোলা এনবিসির মাধ্যমে ফিলিস্তিনের তৃতীয় বৃহত্তম নিয়োগদাতা কোম্পানি ছিল। একইসাথে তাদের ওয়েবসাইটে একটি পুরো পেজই রয়েছে যার টাইটেল হচ্ছে, কোকা-কোলা কি নিজেদের লভ্যাংশ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দিয়ে থাকে?
কোকাকোলার বার্তায় ফিলিস্তিনের জন্য সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে তা রাষ্ট্রয়ত্ব বা অন্য কিছুর জন্য নয়। বরং তা সেখানকার জনগণের জন্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনটি বরং অনেকটা গ্যাসলাইটিং হিসাবে কাজ করেছে।
নতুন বিজ্ঞাপনটিতে কোকাকোলাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এখানে কোকাকোলাকে ১৯৬৬ সালে আরব লীগ যে ২০ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেছিল সেই বিষয়টির ব্যাখ্যা উঠে আসেনি। মূলত ম্যানহাটনের ব্যাংকার ও তৎকালীন ইসরায়েল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম ফেইনবার্গকে ইসরায়েলি কোকা-কোলা ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে যুক্ত করার কারণে এ নিষেধাজ্ঞার সূত্রপাত হয়েছিল।
এদিকে পশ্চিম তীরের অধিকৃত অঞ্চলে কোকাকোলার ফ্যাক্টরিগুলোকেও বিতর্কিত বলে মনে করা হয়। সেক্ষেত্রে ২০২০ সালে জাতিসংঘও অবৈধভাবে ইসরায়েলি বসতিতে কার্যক্রম পরিচালিত করায় কোম্পানিটিকে 'কালো তালিকাভুক্ত' করেছিল। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞাপনে শুধু 'ওই দেশ' বলা এবং কোনো সম্পর্ক নেই বলে প্রচার করা বেশ বিভ্রান্তিকর।