জুনের মধ্যে ইচ্ছাকৃত খেলাপি শনাক্ত করবে ব্যাংক

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২১ মে ২০২৪, ১১:২৭ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা দেয়ার পর আগামী জুন মাসের মধ্যে তাদের সনাক্ত করে তালিকা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মঙ্গলবার (২১ মে) সার্কুলার দিয়ে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলেছে, আগামী ১ জুলাই থেকে খেলাপিদের তিন ভাগে ভাগ করে জমা দিতে।
নির্দেশনায় বলা হয়, ‘‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার তথ্য আগামী ১ জুলাই থেকে সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) ডাটাবেইজে হালনাগাদ বা তালিকা আকারে দিতে হবে।’’ আগামী জুন পর্যন্ত যারা খেলাপি হবে তাদের তালিকা দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব ঋণ গ্রহীতাদের তিন ভাগে ভাগ করতে হবে নির্দেশনা পালন করতে। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ‘নো’, খেলাপি হলে ‘ওয়াই’, কিন্তু ইচ্ছাকৃত না হলে তার বিপরীতে ‘নো’ লিখতে হবে। আর খেলাপি গ্রহীতা ইচ্ছাকৃত হলে তার বিপরীতে ‘ডব্লিউ’ লিখতে হবে।
এর আগে গত মার্চে সার্কুলার দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি বলেছিল, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সনাক্ত করতে। সেখান থেকে সড়ে এসে জুন পর্যন্ত সময় বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে নির্দেশনা মেনে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্তকরণ ইউনিট নামে পৃথক ইউনিট খুলতে হয়েছে প্রতি ব্যাংকে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরবর্তী দুই ধাপ নিচের কোনো কর্মকর্তাকে হবে ইউনিটের প্রধান।
খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ব্যাংকিং খাতের ঋণ ব্যবস্থাপনার অন্যতম প্রধান অন্তরায় উল্লেখ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মার্চে বলেছিল, ‘‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হলে শ্রেণিকৃত ঋণ হ্রাসসহ ব্যাংকিং খাতের ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।’’
ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংজ্ঞা
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘‘এমন কোনো খেলাপি ঋণ গ্রহীতা ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি যা- নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির অনুকূলে কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে গৃহীত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোন আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ বা এর উপর আরোপিত সুদ বা মুনাফা তার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরিশোধ করে না।’’
এছাড়া ‘‘কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নিজের, তার পরিবারের সদস্যের, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির নামে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করলে।’’
যে উদ্দেশ্যে ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা এমন অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা নেয়া হয়, সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে উক্ত ঋণ, অগ্রিম, বিনিয়োগ বা আর্থিক সুবিধা বা এর অংশ ব্যবহার করলেও তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।
তালিকা চূড়ান্ত হবে যেভাবে
ইচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করার পর তা চূড়ান্ত করতে ওই গ্রাহককে নোটিস দিতে হবে। কোনো খেলাপি শনাক্ত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ইচ্ছাকৃত কি না, তার সিদ্ধান্ত নেবে এ সংক্রান্ত ইউনিট। যৌক্তিক কারণে সময় বাড়ানোর সুযোগও রাখা হয় নির্দেশনায়।
শনাক্তকরণের কারণ জানিয়ে ঋণ গ্রহীতাকে ১৪ দিন সময় দিয়ে জবাব দিতে বলা হবে। তবে শিল্প নীতিতে বর্ণিত সংজ্ঞানুযায়ী 'বৃহৎ শিল্প' খাতের ৭৫ কোটি ও তদূর্ধ্ব, 'মাঝারি শিল্প' খাতের ৩০ কোটি ও তদূর্ধ্ব এবং অন্যান্য খাতের ১০ কোটি ও তদূর্ধ্ব স্থিতির ঋণের বিষয়ে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির/পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। গ্রাহক চাইলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে আপিল করতে পারবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
যেসব নিষেধাজ্ঞায় পড়বে ইচ্ছাকৃত খেলাপি
বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) কাছে কোম্পানি নিবন্ধনে নিষেধাজ্ঞা দিতে চিঠি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য হবেন না। গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে ঋণ পরিশোধ করলেও পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবে না ওই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে তার পরিচালক পদ শূন্য হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতার সংশ্লিষ্ট ঋণের আরোপিত বা অনারোপিত কোনো সুদ মওকুফ করা ও পুনঃতফসিল করতে পারবে না ব্যাংক। খেলাপি হওয়া ঋণ অন্য কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি বা টেকওভার করা যাবে না। পুরো ঋণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।
অন্যদিকে এমন গ্রাহক শনাক্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে সার্কুলারে। এমন নির্দেশনা লঙ্ঘনে অভিযুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। এছাড়া ধারাবাহিকভাবে নির্দেশনা লঙ্ঘন হলে প্রত্যেক দিনের জন্য অতিরিক্ত এক লাখ টাকা জরিমানা আরোপ হবে।
প্রতি তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রতিবেদন আকারে জমা দেয়ার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে।
ইচ্ছাকৃত খেলাপি সনাক্ত হওয়ার দিনই সিআইবিতে রিপোর্ট করতে হবে এমন পদক্ষেপের দিকে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।