রাজস্ব অব্যাহতি কমানোর পরামর্শ দিলো আইএমএফ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৮ এএম
শিল্প বিকাশের স্বার্থে প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব অব্যাহতি দিয়ে আসছে সরকার। এই রাজস্ব অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ)। গতকাল রবিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিভিন্ন উইংয়ের সঙ্গে হওয়া বৈঠকে এমন পরামর্শ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এদিন সকাল থেকে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাটের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফের ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। সবশেষ এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গেও বৈঠক করেন আইএমএফ কর্মকর্তারা। বৈঠকে রাজস্ব ছাড় কমিয়ে আনাসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দেয় আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি।
বৈঠকে অংশ নেয়া এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিবেদককে জানান, এনবিআরের আয়কর নীতি, ভ্যাট নীতি বাস্তবায়ন এবং কাস্টম নীতির সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। বৈঠকে আয়কর বাড়ানোর বিষয়ে এনবিআরের পরিকল্পনা জানতে চান তারা। জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা কর হার না বাড়িয়ে কর ফাঁকি বন্ধে জোর দেয়া হয়েছে বলে জানান। এতে আয়কর খাতে সবশেষ তিন মাসে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের কোটায় রয়েছে বলেও আইএমএফ প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। কর হার না বাড়িয়ে আয়কর আদায় কীভাবে বাড়ানো হবে- আইএমএফের এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের আয়কর কর্মকর্তারা বলেন, কর জাল বাড়াতে ইতোমধ্যে জোন সম্প্রসারণসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কর ফাঁকি বন্ধ করে সেই সঙ্গে করের আওতা বাড়ালে আয়কর আরো অনেক বাড়বে বলেও আইএমএফ কর্মকর্তাদের জানায় এনবিআর। আর কর অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, প্রতি বাজেটে বিভিন্ন খাতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর ছাড় কমানো হয়েছে। আর নতুন নতুন খাতকে করের আওতায় নিয়ে এসে আয়কর খাতে অব্যাহতি আরো কমানো হবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এনবিআরের শুল্ক খাতের সঙ্গে কাস্টমস এবং বন্ডে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব অব্যাহতি কমানোর বিষয়েও জানতে চান আইএমএফ কর্মকর্তারা। নতুন শুল্ক আইন কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে এই বিষয়ে জানতে চান তারা। এর জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, দেশীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ করে আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়া হচ্ছে। এছাড়া শিল্প বিকাশের স্বার্থে বন্ডে ছাড় অব্যাহত রয়েছে। তবে বাস্তবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে এসব খাতে কর অব্যাহতি কমানো হচ্ছে। বিশেষ করে বন্ডের কিছু কিছু বিষয়ে নতুন করে করারোপ করা হচ্ছে। প্রতি বছর বাজেটে ভর্তুকি কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর কাস্টম আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, ইতোমধ্যে কাস্টম আইন প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে এই আইনটি পাসের অপেক্ষায় রয়েছে। কত সময়ের মধ্যে এই আইন পাস হবে- আইএমএফের এমন প্রশ্নের জবাবে এনবআির কর্মকর্তারা বলেন, জাতীয় সংসদে পাস হলেই বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। তবে কবে পাস হবে তা তারা বলতে পারবেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত এনবিআরের এক ঊর্ধতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, আইএমএফের সঙ্গে আমাদের ট্র্যাডিশনাল আলোচনা হয়েছে। তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। বিশেষ করে বন্ড, কাস্টমস এবং ভ্যাটে অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছেন। কাস্টম আইনের বাস্তবায়ন নিয়েও তারা জানতে চেয়েছে। এছাড়া কর অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছে। আমরা প্রতি বছর বাজেটে একটু একটু করে অব্যাহতি কমানোর চেষ্টা করছি। সামনে অব্যাহতি আরো কমবে বলেও আইএমএফকে জানিয়েছি আমরা।
সূত্র আরো জানায়, এনবিআরের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ ভ্যাট অটোমেশনের ক্ষেত্রে জোর দিয়েছে। অটোমেশনের আওতায় ই-ফাইলিং থেকে শুরু করে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার বিষয়েও জানতে চেয়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা। জবাবে ভ্যাট অটোমেশনের বিষয়টি তুলে ধরে এনবিআর। সেই সঙ্গে ই-ফাইলিংয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে এবং ইএফডির অগ্রগতিও তুলে ধরা হয়। তামাকের কর হার বাড়ানোর বিষয়টিও জানতে চান আইএমএফ কর্মকর্তারা। জবাবে এনবিআর কর্মকর্তারা বর্তমানে দেশে তামাকের সর্বোচ্চ কর হারের বিষয়টি আইএমএফকে অবহিত করেন। আর ভ্যাট অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, ইতোমধ্যে নতুন নতুন কিছু পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোনে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। যেখানে আগে ভ্যাট ছিল না। আরো কিছু কিছু খাতকে ভ্যাটের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভ্যাট অব্যাহতি কমানোর বিষয়ে এনবিআর জোর দিচ্ছে বলেও আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের অবহিত করেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভর্তুকি কমানো। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর স্বার্থে যেসব দেশে আইএমএফ ঋণ দেয়, সেসব দেশে ভর্তুকি কমানোর তাগিদ দেয় তারা। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভর্তুকি কমানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ ভোরের কাগজকে বলেন, এনবিআরের যেসব বিষয় নিয়ে আইএমএফ প্রস্তাব দিয়েছে, এমন প্রস্তাব দীর্ঘদিন থেকে দেশের বিনিয়োগকারী এবং বিশ্লেষকরা দিয়ে আসছেন। আসলে এসব বিষয়ে সংস্কার অনেক আগেই করা উচিত ছিল। এখন আইএমএফ এসব বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। বিশেষ করে কাস্টম আইন কেবিনেটে পাস হওয়ার পরও আটকে আছে, যা খুবই দুঃখজনক। এছাড়া ২০১২ সালের ভ্যাট আইনের সবচেয়ে দুর্বল ভার্সন এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় কাস্টম এবং আয়কর আইন বহু পুরনো। এসব আইনের সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার মিল নেই। তাই এসব আইনের সংস্কার হওয়া খুব জরুরি। আর আইএমএফ অটোমেশন এবং ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে- যা অর্থনীতির জন্য খুবই উপযোগী। বর্তমান বাস্তবতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এসব আইন বাস্তবায়ন করতে হবে বলেও মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই সিনিয়র অর্থনীতিবিদ।