কারাগারে ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা গেলেন আওয়ামী লীগের চার নেতা
দল বলছে, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
বগুড়ায় ১১ নভেম্বরের পর থেকে গত এক মাসে কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় অন্তত চারজন আওয়ামী লীগ নেতা মারা গেছেন। 'নাশকতা' কিংবা 'হত্যা মামলার' আসামি হিসেবে তাদের আটক করা হয়েছিল। 'হার্ট অ্যাটাক কিংবা অন্য অসুস্থতায়' এদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে নিহতদের একজনের সন্তান জানান, তার বাবা কখনই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন না। কারাগারে যখন সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন তখনও কোনো অসুস্থতার কথা জানা যায়নি।
কারাগারে আটক অবস্থায় মারা যাওয়া আরো দুজনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ বলছে 'এগুলো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড'। যদিও কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, আওয়ামী লীগের এসব নেতা আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে।
তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলেন, কারাগারেই হোক আর পুলিশ হেফাজতে হোক- এ ধরনের মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। মানবাধিকার সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কারাগারে হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৬২ জনের। এদের মধ্যে বিচারাধীন বন্দি ছিলেন ৩৯ জন। আর সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন ২৩ জন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে বিদায়ী সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন কিংবা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন- এমন বহু মানুষকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের বহু নেতা, কর্মী ও সমর্থককে 'নাশকতা' কিংবা 'হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। যাদের অনেককে এর মধ্যে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ভারতে অবস্থানরত দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে ২৫০টির বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব মামলায় জুলাই ও আগস্টের 'আন্দোলনের সময় গুলি করে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার' অভিযোগ আনা হয়েছে।
বগুড়া কারাগারে আটক আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে সবশেষ ৯ ডিসেম্বর (সোমবার) মৃত্যু হয়েছে জেলার গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মিঠুর। তিনি দলের ইউনিয়ন কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। একটি হত্যা মামলার আসামি হিসেবে আটকের পর গত ৩ নভেম্বর তাকে বগুড়া কারাগারে নেয়া হয়েছিল।
কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই দিন ভোরে বুকে ব্যাথা অনুভব করলে আব্দুল মতিন মিঠুকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এর আগে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল লতিফ, বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম রতন এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদত আলম ঝুনুও আটক থাকা অবস্থায় অসুস্থ হয়ে মারা যান। আব্দুল লতিফ গত ২৫ নভেম্বর আর শহিদুল ইসলাম ১১ নভেম্বর মারা গেছেন।
শাহাদত আলম ঝুনুকে তিনটি হত্যা মামলাসহ মোট পাঁচটি মামলার আসামি করা হয়েছিল। তাকে গত ২৫ আগস্ট তার বগুড়ার বাসা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ আটক করেছিল। এরপর থেকে তিনি জেলা কারাগারে ছিলেন এবং কারাগারে থাকা অবস্থাতেই গত ২৬ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শাহাদত আলম ঝুনু অসুস্থ হয়ে পড়লে বগুড়ার জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপর অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু ঢাকায় নেয়ার পথেই সিরাজগঞ্জে মারা যান তিনি।
শাহাদত আলম ঝুনুর ১৪ বছর বয়সী সন্তান রিয়াদ উল আলম তার মায়ের অনুমতিক্রমে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় মা পাশেই ছিলেন। রিয়াদ উল আলম বলেন, মায়ের পক্ষ থেকে আমিই কথা বলছি। আমার বাবার কখনই হৃদরোগ ছিলো না। আমরা কারাগারে যখন সাক্ষাত করেছি তখনো এমন কোনো অসুস্থতার কথা উনি বলেননি।
শাহাদত আলম ঝুনু রাজনীতির পাশাপাশি বগুড়ার একটি সুপরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ছিলেন। ’৮০-এর দশকে ছাত্ররাজনীতি করার সময় থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বলেন, ঝুনু গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্তেও আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। সুস্থ সবল ও সজ্জন মানুষটা আটক হয়ে কারাগারে গেলো। অন্তর্বর্তী সরকার তার লাশ উপহার দিলো। ঝুনুসহ চারজনই কারাগারে সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হচ্ছেন। তার দাবি এসব হামলা 'পরিকল্পিত'। তবে বগুড়া জেলা কারাগারের জেলা সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, যারা মারা গেছেন তারা বয়স্ক এবং কারাগারে আসার আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে।
তিনি বলেন, কারাগারে আসামিদের প্রতি বিন্দুমাত্র অবহেলা হয়নি। কেউ ডায়াবেটিস, কেউ হৃদরোগ কিংবা কেউ প্রেশারের রোগী ছিলেন আগে থেকেই। রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় হয়তো মানসিক চাপ বা হতাশায় অসুস্থতা বেড়ে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়েছি।
ফারুক আহমেদ বলেন, কারাগারের ভেতরে কেউ অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে কারা হাসপাতালে নেয়া হয় এবং চিকিৎসকরা পরামর্শ দিলে জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না বলেন, কারাগারে হোক আর পুলিশ হেফাজতে হোক- একজন আটক ব্যক্তি যখন মারা যান, তখন তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে অবশ্যই এর দায় নিতে হবে। আবার কারা কর্তৃপক্ষ যদি বলেন, তারা আগেই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন তাহলে তো তাদের আগে থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধায়নে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু এসব ঘটনায় কী সেটি করা হয়েছে?। আটকের সময়ই যদি একজন মানুষ খুব অসুস্থ থাকেন, তাহলে সে অনুযায়ী পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে হবে।