হাওরে দেশি জাতের ধান আবাদ কমেছে

রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ)
প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:৩২ পিএম

ছবি: ভোরের কাগজ
সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে মাত্র ০.৫ শতাংশ জমিতে দেশি বোরো ধান আবাদ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হয়েছে উফশী ও হাইব্রিড। বহুজাতিক কোম্পানি বাজারজাতকৃত হাইব্রিড ধান চাষ হাওরে ক্রমেই বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত কমছে রোগ প্রতিরোধ ও পুষ্টিগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন সুগন্ধি দেশি ধান চাষ।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মধ্যনগর উপজেলায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৪ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে হাইব্রিড ৫৫ শতাংশ, উফশী ৪৪.৫ শতাংশ এবং দেশীয় প্রজাতির বোরো ধান মাত্র ০.৫ শতাংশ। এরইমধ্যে গড়ে ৯২ শতাংশ জমিতে বোরো ধান লাগানো হয়েছে।
কৃষি বিভাগের মতে, হাওরে ১১ হাজার ৩৯৭ হেক্টর জমির শতভাগ এবং নন হাওরে (উঁচু জমি) ২ হাজার ৩০৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে অবশিষ্ট জমিতে ধান রোপণ শেষ হবে। মধ্যনগর উপজেলার মধ্যনগর বাজারটি দেশের সর্ববৃহৎ দেশীয় ধানের বাজার হিসেবে সুপরিচিত ও বিখ্যাত।
একসময় এ উপজেলার হাওর-বাঁওড়সহ জলাভূমিতে প্রায় ২২৮ প্রজাতির দেশি বোরো ধান চাষ করা হতো। স্থানীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করত এসব দেশি প্রজাতির ধান।শাইল বোরো, জগলি বোরো, ঝরাবাদল, বাঁশফুল, বর্ণজিরা,কালিজিরা, তুলসীমালা, গাজী,বাদশা ভোগ, রাঁধুনি পাগল, জোয়ালকোট, মধুমাধব, খাসিয়া বিন্নি, বেগুন বিচি ধান ছিল উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, স্বাধীনতার পর সবুজ বিপ্লব আন্দোলনে অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে দেশি ধান। বানের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এই ধান ছিল হাওড়ের কৃষকের ভরসা ও শক্তির প্রতীক। বেশি ফলনের কথা বলে সরকারি-বেসরকারিভাবে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান চাষ করা হচ্ছে চার দশক ধরে। তবে ফলন বেশি হলেও দেশি ধানের তুলনায় উফশী ধান পাকে দেরিতে। ফলে আগাম বন্যায় প্রতি বছর এই ধানের ক্ষতি হয়। সে তুলনায় অল্প জমিতে কৃষকরা দেশি ধান রোপণ করে লাভবান হচ্ছে। খরচ ছাড়াই চাষকৃত দেশি ধান পানি আসার আগেই কেটে ফেলা যায়।
তারা আরো জানান, বাজারে অন্য ধানের চালের চেয়ে দেশীয় জাতের এসব ধানের চালের মূল্যও দ্বিগুণ এবং পুষ্টিগুণও বেশি, খেতেও সুস্বাদু। তাছাড়া এসব দেশী ধানের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, বন্যা ঝুঁকিমুক্ত এবং চাষবাসে ব্যয়ও কম হয়ে থাকে।
উপজেলার বংশীকুণ্ডা গ্রামের কৃষক এবিএম জুয়েল তালুকদার বলেন, দেশি ধান হাওরের কাছে এখন স্মৃতির নাম। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী এই ধান চাষ অস্বাভাবিক রকম কমে গেছে। কিন্তু অনেকের কাছে এই ধানের চালের চাহিদা এখনো রয়ে গেছে। তারা বেশি দামে এই ধানের চাল এখনো কিনে খান। প্রচারণার অভাব ও বিজ্ঞান প্রলোভিত হয়ে কৃষকরা এই ধান চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন। তবে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে অনন্য হাওড়াঞ্চলের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হাওড় এলাকার কিছু কৃষক আজো দেশি ধান চাষ করছেন।
উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম জানান, তিনি টাঙ্গুয়ার হাওড়ে এবারো ২৫ বিঘা জমিতে দেশি জাতের ধান শাইল বোরো চাষ করছেন। বীজ ছিল নিজের ঘরের। সর্বসাকুল্যে ব্যয় হতে পারে ৪০-৫০ হাজার টাকা। ক্ষেতে চারা রোপণের পর কোনো সার বা কীটনাশক দিতে হয় না। আগাছা দমণ করতে হয় না, দিতে হয় না পানি সেচ। ফলনও হয় ভাল। মৌসুমে সবার শেষে রোপণ করে সবার আগে ধান গোলায় তোলা যায়। বিঘাপ্রতি ১০ মণ হারে ধানের ফলন হবে বলে তিনি আশাবাদী।
মধ্যনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা(অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব) আব্দুল্লাহ আল মাসুদ তুষার বলেন, দেশি ধানের ফলন কম হয়। এই তুলনায় হাইব্রিড ধানের ফলন বেশি। যে কারণে কৃষকরা এখন উফশী ধানের পাশাপাশি হাইব্রিড ধানের দিকে ঝুঁকছেন। হাইব্রিড যেখানে ২০-২৩ মণ বিঘাপ্রতি চাষ হয়, সেখানে দেশি ধান মাত্র চার-পাঁচ মণ হয়।