ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অনবদ্য আয়োজন ‘হারমোনি ফেস্টিভ্যাল’

সাইফুল ইসলাম সুমন, শ্রীমঙ্গল থেকে ফিরে
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে তিন দিনব্যাপী ‘হারমোনি ফেস্টিভ্যাল’ উদ্বোধন করা হয়েছে। উৎসবে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে বসবাসরত ২৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ও জীবনচর্চার বিষয় উপস্থাপন করছে।
শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) বিকেলে শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ চা-গবেষণা কেন্দ্র সংলগ্ন কাকিয়াছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এই উৎসব উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, গেস্ট অব অনার বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন।
অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী, এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদর্শন কুমার রায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন।
আয়োজকরা জানান, প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে উৎসব। এখানে স্থানীয় বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন উপকরণের প্রদর্শনী ও মেলাও অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
উৎসব মাঠে দেখা গেছে, এই অঞ্চলে বসবাসরত সব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার উদ্যোগ সফল হয়েছে। মেলায় ৪৪টি স্টলের মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত পণ্য, খাবার, জীবনাচার, পোশাক ইত্যাদি প্রদর্শন ও বিক্রয় করছেন। এছাড়া উদ্বোধনের পরপরই অনুষ্ঠান মঞ্চে সাংস্কৃতিক পর্বে পারফরমেন্স শুরু হয়।
পরিবেশনার ক্রমানুসারে খাসিয়া, গারো, মণিপুরী, ত্রিপুরা, সবর, খাড়িয়া, রিকিয়াসন, বারাইক, কন্দ, রাজবল্বব, ভূঁইয়া, সাঁওতাল, ওরাও, গড়াইত, মুন্ডা, কুর্মী, ভুমিজ, বুনারাজি, লোহার, গঞ্জু, কড়া জনগোষ্ঠী অংশ নেয়।
এ অঞ্চলের সবর জনগোষ্ঠী পত্র সওরা নৃত্য ও চড়ইয়া নৃত্য, খাড়িয়াদের খাড়ি নৃত্য, রিকিয়াসনদের লাঠি নৃত্য, বাড়াইকদের ঝুমুর নৃত্য, কন্দদের কুই নৃত্য, রাজবল্ববদের উড়িয়া নৃত্য, ভূঁইয়াদের ভূঁইয়া গীত, সাঁওতালদের লাগড়ে নৃত্য, ওরাওদের ওরাও নৃত্য, গড়াইতদের গড়াইত নৃত্য, মুন্ডদের মুন্ডারি নৃত্য, কুর্মীদের কুরমালি নৃত্য, ভূমিজদের ভূমিজ নৃত্য, বুনারাজিদের উড়িয়া ভজন, লোহারদের ভুজপুরি রামায়ন কীর্তন, গঞ্জুদের গঞ্জু নৃত্য, কড়াদের কড়া নৃত্য, খাসিয়াদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ডিয়া কেরছা ও মালা পরিধানের মাধ্যমে নাচ-গান, তীর-ধনুক প্রতিযোগিতা, সীয়াট বাটু (গুলতি দিয়ে খেলা), কিউ থেনেং ( তৈলাক্ত বাঁশে উঠার প্রতিযোগিতা), ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর কাথারক নৃত্য, বেসু নৃত্য, জুম নৃত্য, গ্যারি পুজা, ক্যার পুজা, নক থাপেং মা পুজা, কাদং (রনপা), গারো জনগোষ্ঠীর জুম নৃত্য, আমোয়দেব (পুজা), গ্রীক্কা নাচ (মল্লযুদ্ধ), চাওয়ারী সিক্কা (জামাই-বৌ নির্বাচন), চাম্বিল নাচ (বানর নৃত্য), মান্দি নাচ, রে রে গান, সেরেনজিং (প্রেমকাহিনীর গান), মণিপুরী জনগোষ্ঠীর রাসলীলা নৃত্য, পুং চলোম নৃত্য (ঢোল নৃত্য), রাধাকৃষ্ণ নৃত্য এবং সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ধামাইল নৃত্য একে একে প্রদর্শন করা হয়।
এছাড়া খাসিয়া জনগোষ্ঠীর পান নিয়ে লাইভ পরিবেশনা, ত্রিপুরাদের কোমর তাঁত, মনিপুরীদের লাইভ তাঁত, চা ও রাবার প্রসেসিং, হোমস্টে, কুমারদের লাইভ মাটির জিনিসপত্র প্রস্তুত করা সরাসরি দেখছেন উৎসবে আগত দর্শনার্থীরা। এই উৎসব শুধু একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নয়, বরং এমন এক মঞ্চ যেখানে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনকে তুলে ধরা হয়েছে।