×

সারাদেশ

সিন্ডিকেটের দখলে হাজারী গুড়

Icon

সুরেশ চন্দ্র রায়, মানিকগঞ্জ

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫০ পিএম

সিন্ডিকেটের দখলে হাজারী গুড়

ছবি: ভোরের কাগজ

   

“লোকসংগীত আর হাজারী গুড় মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর” স্লোগানে সরকার মানিকগঞ্জ জেলার ব্যান্ডিং শুরু করেন। ঝিটকা এলাকার সেই হাজারী গুড় উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ক্রেতারা গুড়ের গুণগতমান ও দামের দিক থেকে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ কতিপয় ক্রেতা ও গাছির।

ঝিটকা এলাকার একজন প্রবীণ কলেজ শিক্ষক জানান, মানিকগঞ্জের ঝিটকা এলাকার হাজারী গুড়ের পরিচিতি বিশ্বখ্যাত। কথিত রয়েছে, ব্রিটেনের রানী ঝিটকা এলাকার গুড়ের স্বাদ আস্বাদনে বিমোহিত হয়ে গুড় তৈরির কারিগরকে “হাজারি” খচিত একটি সীল  উপহার দেন। সেই থেকে ওই কারিগর গুড়ের পাটালীতে “হাজারি” সীল ব্যবহার শুরু করেন। 

ব্রিটিশ রানীর স্বীকৃতি, স্বাদের ভিন্নতা আর “হাজারী” লেখা মনোগ্রামের কারণে খুব অল্পদিনেই গোটা বিশ্বে এ গুড় লাভ করে বিশ্ববরেণ্যদের ভুয়সী প্রশংসা। কিন্তু সম্প্রতি এই গুড়ের দাম আকাশচুম্বী হলে নেই আগের সেই গুণগতমান। এখন দেশের কতিপয় বিত্তশালী এগুলো উচ্চমূল্য দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ধনাঢ্য শ্রেণির ক্রেতাদের বোকা বানিয়ে ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছেন দ্বিগুণ দাম। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশাসনের নেই কোনো নজরদারি।

ঝিটকা এলাকার এক গাছি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনিও দীর্ঘদিন হাজারীর তালিকার অন্তর্ভুক্ত থেকে হাজারী পরিবারের সীল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এ বছর হাজারী পরিবারের সঙ্গে তাদের পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে হাজারী পরিবার তাদের “হাজারী” সীল ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না। সীলের ভাড়া হিসেবে হাজারী পরিবারকে দিতে হয় নগদ অর্থ অথবা বেশ পরিমাণ গুড়। “হাজারী” সীল ছাড়া তিনি এ বছর ৮ শ টাকা কেজি দরে গুড় বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীরা একই গুড় তাদের কাছ থেকে নিয়ে “হাজারী” সীল ও প্যাকেটজাত করে ১৬শ থেকে ২ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করে থাকেন। বর্তমানে এই এলাকায় এমন কোনো গাছি নেই যে তার গুড়ে চিনির মিশ্রণ দেন না। ব্যবসায়ীদের নির্দেশেই গাছিরা গুড়ে কমবেশি চিনি মিশ্রণ করে থাকেন। 

এক কেজি চিনির দাম ১২০ টাকা আর “হাজারী” সীল যুক্ত এক কেজি গুড়ের দাম ১৬শ থেকে ২ হাজার টাকা। নতুন তালিকায় ৪৬জন ব্যক্তি এ পেশায় যুক্ত  রয়েছেন। এর মধ্যে ব্যবসায়ী রয়েছেন ৭জন। এই ৭ জন ব্যবসায়ীর প্রত্যেকের অধীনে আছেন ১০-১৫ জন গাছি। এই গুড় তৈরি করতে খেজুর গাছ ৭ দিন বিশ্রামে রেখে ২ দিন কাটতে হয়। নিয়মমাফিক প্রথম দিনের রস দিয়ে “হাজারী” এবং দ্বিতীয় দিনের রস দিয়ে “নাম্বারি” গুড় তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের নির্দেশে প্রথম এবং দ্বিতীয় দিনের সবগুড়ই হয়ে যায় “হাজারী”। 

ব্যবসায়ীরা গাছিদের কাছ থেকে ১হাজার টাকা কেজি দরে গুড় কিনে ১৬শ থেকে ২ হাজার টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন। ১ জন গাছি মাসে ৮দিনের বেশি গাছ কাটতে পারেন না। একজন গাছি প্রতিমাসে গড়ে তৈরি করেন ২৫ কেজি গুড়। এই হিসেবে ৩৯ জন গাছি প্রতিমাসে গড়ে গুড় উৎপাদন করে থাকেন প্রায় ২৫মন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিমাসে গাছিরা একত্রে পেয়ে থাকেন প্রায় ১০ লাখ টাকা। আর ব্যবসায়ীদের পকেটে যায় ১৬ থেকে ২০লাখ টাকা।

তালিকাভুক্ত এক গাছির ছেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিবছরই হাজারী পরিবারকে সীলের ভাড়া হিসেবে গুড় দিতে হয়। তবে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে হাজারী পরিবার নিজেদেরকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তারা গাছিদেরকে ১০টাকা মূল্যের গুড়ের প্যাকেট ও কার্টুন  ৫০ টাকায় ক্রয় করতে বাধ্য করছেন। ডিম পাড়ে হাসে খায় বাগডাসে-এটি প্রবাদ বাক্য হলেও ঝিটকা এলাকার গাছিদের ক্ষেত্রে এটি যেন প্রযোজ্য বাক্য। ব্যবসায়ীদের তালিকায় রয়েছেন-মো. শফিকুল ইসলাম হাজারী শামীম, সোহরাব উদ্দিন হাজারী, আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা, মোতাহার হোসেন, রহিজ উদ্দিন হাজারী, মাসুদ হাজারী, মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম হাজারী প্রমুখ। অনতিবিলম্বে এই সিণ্ডিকেট ধ্বংসের জন্য প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

ঝিটকা বাজারের খুচরা গুড় ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ, রহিজ হাজারী, আনোয়ার হোসেন, হায়দার মন্ডল, মো.লাভলু, আব্দুর রাজ্জাক রাজা, মো.আতোয়ার রহমান ও আব্দুল মুন্নাফ শেখ জানান, তারা এ বাজারে ২৬ জন খুচরা ব্যবসায়ী রয়েছেন। প্রতিদিন প্রত্যেক ব্যবসায়ী গড়ে ১৫ কেজি গুড় বিক্রি করে থাকেন। হাজারী গুড় ১২শ থেকে ১৬শ এবং নাম্বারি গুড় সাড়ে ৩শ থেকে ৯শ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। 

গুড়ের গুণগতমান সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা স্পষ্টভাবে বলেন, হাজারী, নাম্বারী আর লাল গুড় প্রত্যেকটার মধ্যেই প্রতি কেজিতে একশো গ্রাম চিনি আছে। ঝিটকা এলাকায় প্রতিমাসে গুড় উৎপাদন হয় প্রায় ২৫ মন। কিন্তু এই বাজারে মাসে বিক্রি হয় প্রায় তিনশো মন গুড়। তাহলে বাকি ২শ ৭৫ মন গুড় কীভাবে কোথায় থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং এই গুড়ের গুণগতমান কী প্রশ্নে কেউ কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

ব্যবসায়ী সোহরাব হাজারী জানান, এখন বিক্রি করা হচ্ছে হাজারী গুড় ১৬শ টাকা এবং নাম্বারী গুড় ৮শ টাকা কেজি দরে। তবে,আগামী সপ্তাহ থেকে দুই হাজার টাকা কেজি দরে হাজারী বিক্রি করা হবে। 

গুড়ের মান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার গুড়ে বিন্দুমাত্র চিনি নেই। আপনি নিজে গুড় তৈরি করেন কিনা প্রশ্নে তিনি জানান, তার গাছি রাখা আছে। তারাই গুড় তৈরি করেন। গাছিদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা দরে গুড় কিনে ১৬শ টাকা দরে বিক্রি করা কী অতিরিক্ত নয় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি মিথ্যা কথা। তিনি গাছিদের কেজি প্রতি ১২-১৩শ টাকা দেন বলে স্বীকার করেন। তিনি আরো বলেন, এ এলাকার হাজারী গুড় তার নিয়ন্ত্রণে চলে। তার অনুমতি ছাড়া কেউ “হাজারী” সীল ব্যবহার করতে পারবেন না।

মানিকগঞ্জ জেলা ক্যাব সভাপতি সামছুন্নবী তুলিপ বলেন, এ বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত আছেন। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নবনিযুক্ত সহকারী ওমরা হজ্জে যাওয়া অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে। তবে, অনতিবিলম্বেই অভিযান পরিচালনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে অফিস সূত্রে জানা যায়, সহকারী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদাউস ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে গিয়েছেন। এখনো অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি।

হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাহরিয়ার রহমান জানান, এ বিষয়ে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জেলা প্রশাসক ড.মনোয়ার হোসেন মোল্লা দৈনিক ভোরের কাগজকে জানান, তিনি একটি জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। এ বিষয়ে তিনি পরে কথা বলবেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App