অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হচ্ছে নাপ্পি, নেই তদারকি

আনোয়ার হোসেন আনু, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনপ্রিয় খাদ্য ‘নাপ্পি’। বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে আচারের মতো এই নাপ্পি খেয়ে থাকেন আদিবাসী রাখাইনসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। তরকারির স্বাদ বাড়াতে নাপ্পির ব্যবহার করে থাকে তারা। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কাছে এ খাবার বেশ জনপ্রিয়।
একসময় ঘরে বসেই এই নাপ্পি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা তৈরি করে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতেন। এখন সেই নাপ্পি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত হয়ে আসছে। তবে এর তৈরি প্রক্রিয়া ভিন্ন। প্রতি বছর শীত মৌসুমে পটুয়াখালীসহ সমুদ্র উপকূলের শুঁটকি পল্লীতে চলে ‘নাপ্পি’ প্রক্রিয়াজাতকরণ।
পটুয়াখালীর সমুদ্র উপকূলজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হচ্ছে নাপ্পি। কিন্তু এ নাপ্পি তৈরিতে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি। একদিকে যেমন মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, অন্যদিকে খালি পা ও নোংরা জুতা ব্যবহার করা হচ্ছে এই খাদ্য তৈরিতে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি নাপ্পি প্রক্রিয়াজাতকরণে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
ছোট ভুলা চিংড়ি মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক ছোট মাছের মিশ্রণে তৈরি করা হয় ‘নাপ্পি’। সঙ্গে যোগ হয় আরো কিছু বাড়তি উপাদান। শুরুতে তীব্র দুর্গন্ধ যুক্ত হলেও প্রক্রিয়াকরণ শেষে তা অনেকাংশে কমে যায়। এই নাপ্পি যে কোনো তরকারিতে বাড়তি স্বাদের জুড়ি নেই। এছাড়া পার্বত্যাঞ্চলের বাঙালিদের খাবারের তালিকায়ও ’নাপ্পি'র’ বেশ কদর রয়েছে।
সমুদ্রের ডুবো চর এলাকা থেকে নিষিদ্ধ বেহুন্দি জাল পেতে শিকার করা হয় ছোট ভুলা চিংড়ি মাছ। এসব ছোট ভুলা চিংড়ি মাছের সঙ্গে নানা প্রজাতির ছোট মাছ ধরা পড়ে। পাইকাররা এসব মাছ খোলা ডাকের মাধ্যমে কেনেন। ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকা থেকে এসব মাছ এনে নির্দিষ্ট স্থানে পচানোর জন্য স্তূপ করা হয়। পচা চিংড়ি মাছ প্রথমে রোদে হালকা শুকানো হয়। এরপর অপরিষ্কার খালি পায়ে বা নোংরা জুতা পরে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। পা দিয়ে পিষে আবার রোদে শুকানো হয়। রোদে শুকিয়ে রাখা ভুলা চিংড়ি মাছের সঙ্গে লবণ এবং বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয়। এভাবে করে ‘নাপ্পি’ প্রক্রিয়াকরণ শেষ করতে ৫-৬ দিন সময় লাগে। এসব খাদ্যদ্রব্য দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিদের কাছে এটা খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পটুয়াখালীর মহিপুরের নিজামপুর, কোমরপুর, হাজীপুর, চর গঙ্গামতি, কাউয়ার চর, আশাখালীসহ পটুয়াখালী ও বরগুনা সমুদ্র উপকূলের শুঁটকিপল্লী এলাকায় কক্সবাজার থেকে আসা ব্যবসায়ীসহ কয়েকশ মানুষ ‘নাপ্পি’ তৈরিতে কর্মব্যস্ত সময় পার করছে।
তবে স্থানীয় অন্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, যে পদ্ধতিতে ‘নাপ্পি’ তৈরি করা হচ্ছে, তা নিঃসন্দেহে মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
স্থানীয়রা জানান, পচা চিংড়ি মাছ রোদে হালকা শুকিয়ে পা দিয়ে পিসে ‘নাপ্পি’ তৈরি করা হচ্ছে। এতে আমাদের এলাকায় তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। এই দুর্গন্ধে এলাকায় থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। এটা খেলে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, তেমনি পরিবেশও রয়েছে হুমকির মুখে।
স্থানীয় এক স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিক জানান, যে পরিবেশে নাপ্পি তৈরি করে, তা খেলে ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়ের মতো রোগ হবে। আর আমাদের এলাকার পরিবেশ তো নষ্ট হচ্ছেই।
‘নাপ্পি’ ব্যবসায়ী কক্সবাজারের মো. কালাম জানান, আমাদের এলাকার একটি জনপ্রিয় খাবার এটি, যা আমাদের এলাকার পাহাড়ি থেকে সব লোকেরা খান। এতে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। আমরাও এটা খাই।
চট্টগ্রামের আরেক ব্যবসায়ী আবুল কালামের সঙ্গে কথা হলে তিনিও বলেন, ভালো মাছ প্রথমে স্তূপ করে রেখে এরপর রোদে হালকা শুকিয়ে পা দিয়ে পাড়ানো হয়। এরপর নাপ্পি তৈরি করা হয়। এতে ৫-৬ দিন সময় লাগে। তবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে করা হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এ বিষয়ে কথা হয় শুঁটকিপল্লী এলাকার কমরপুরের বাসিন্দা ও শুঁটকি ব্যবসায়ী মো. সাইফুলের সঙ্গে। তিনি জানান, নাপ্পি তৈরির কারণে পুরো পল্লী এলাকায় তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। এসবের সঙ্গে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকি। খালি পেটে এসবের কাছে গেলে বমি চলে আসে। নাপ্পি যতই সুস্বাদু হোক না কেন, তৈরি করার প্রক্রিয়া কেউ দেখলে আর খেতে চাইবে না।
একই অভিযোগ করেন শুঁটকিপল্লীর আরেক ব্যবসায়ী রাকিবসহ কয়েকজন। তারা বলেন, যে পরিবেশে নাপ্পি তৈরিকরণ চলছে, তা আসলেই স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে করা হচ্ছে না। প্রশাসন যেন বিষয়টি তদারকি করে এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। নতুবা এসব বন্ধের দাবি জানান তারা।
নাপ্পি তৈরি হারভেস্টর পদ্ধতিতে হয় বলে জানান কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা।
তিনি বলেন, সামুদ্রিক ছোট মাছ থেকে তৈরি হওয়া ‘নাপ্পি’ আদিবাসীদের একটি জনপ্রিয় খাবার। এটি অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে করতে হবে। আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখব। যদি নিয়মবহির্ভূত এসব প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, তবে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব।
এবিষয়ে পটুয়াখালী জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা আবু রায়হান জানান, মহিপুরসহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় যে ‘নাপ্পি’ তৈরি হয় তা আমার জানা নেই। আমরা নাপ্পি'র স্যাম্পল কালেলশন করে আমাদের ল্যাবে টেষ্ট করে দেখবো। যদি কোন ক্ষতিকর ক্যামিক্যাল বা ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাকের মতো জীবানু পাওয়া যায় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হয় তাহলে তা বন্ধে দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়া হবে।