×

সারাদেশ

বরুনের অপ্রতিরোধ্য সম্ভাবনার প্রতীক্ষায় হাওরের ভাসান পানিতে নায্যতার স্বপ্ন

Icon

রাসেল আহমদ,মধ্যনগর(সুনামগঞ্জ) থেকে

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০০ পিএম

বরুনের অপ্রতিরোধ্য সম্ভাবনার প্রতীক্ষায় হাওরের ভাসান পানিতে নায্যতার স্বপ্ন

ছবি: ভোরের কাগজ

   

সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলাসহ হাওরাঞ্চলের  মানুষ বরুণ নামটির সাথে বিশেষ ভাবে পরিচিত। নিম্নাঞ্চলের বৈশিষ্ট্যময় উদ্ভিদ বরুণের কচি ডগা ভর্তা-ভাজি করে গৃহস্থ নারীরা ধানকাটার মৌসুমে কামলাদের (শ্রমিক) খেতে দেন। বসন্তের শুরুতে সাদা ফুলে ছেয়ে যায় বরুণের ডাল।চৈত্রসংক্রান্তির দিনে হাওরাঞ্চলের নারীরা সংগ্রহ করেন বরুণের ফুল। গ্রামময় গোবরের দলায় গেঁথে দেওয়া হয় বরুণ ফুল। আসছে বছরে পরিবার ও গ্রামসমাজের মঙ্গল কামনায়। বারো মাসের তেরোটি পর্বের মধ্যে এ পর্বটি হাওরাঞ্চলে  আড়িবিষ্ণু সংক্রান্তি নামে পরিচিত। অতঃপর প্রতি বর্ষায় ভাসান পানির সাথে দেখা হয় বরুণের। তখন বরুণের ডালে থোকা থোকা ফল।

যেসব ফলের ভেতরেই থাকে আগামী দিনের অনন্য সব বরুণের সম্ভাবনার বীজ। হাওরাঞ্চলে কমবেশি আট মাস পানি থাকে। শুকনো মৌসুম চার মাস। বর্ষাকালে হাওরজুড়ে ভাসান পানির থইথই। তবে বর্ষার শুরু থেকেই ভাসান পানির সঙ্গী হয় ফলন্ত পোয়াতি বরুণের ঘাড় উঁচু সব ডাল। বরুণগাছ ছাড়াও আরেক বরুণ হাওর-ভাটির ভাসান পানির সঙ্গী হয়েছিলেন। কাগজপত্রে প্রসূন কান্তি (বরুণ) রায় নাম থাকলেও ভাটিবাংলায় তিনি বরুণ রায় নামেই জয় করেছিলেন হাওরবাসীর বিশ্বাস।

প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাসএই হাওরাঞ্চলের ৮০ ভাগ কৃষি জমি একফসলি। তবে একফসলি কৃষি জমি এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একমাত্র জায়গা নয়। এখানে হাওরের পানিতে, ভাসান পানিতে অর্থনৈতিক উৎসের বড়সড় শেয়ার রয়েছে। কিন্তু হাওরের পানি কিংবা ভাসানপানিতে যাদেরকে অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন, তাদের কাছে সেই অধিকার নেই। রাষ্ট্রের রাজস্ব উন্নয়নের নাম করে জমিদারি প্রথার পর হাওরাঞ্চল প্রশ্নহীনভাবে দখল করে নেয় প্রশ্নবিদ্ধ অন্যায় ইজারাদারি। 

হাওর ইজারাদারেরা কিছুদিনের মধ্যেই ‘ওয়াটার লর্ড’ নামে হাওর এলাকার দখলদার হয়ে ওঠে। অন্যায়ভাবে তারা হাওরনির্ভর কৃষক ও জেলের ভাসান পানিতে মাছ ধরার প্রথাগত অধিকারও কেড়ে নেয়। রাষ্ট্র সমানে রাজস্ব আদায়ের নাম করে দেশের সব হাওর-জলাভূমি ইজারা দিতে থাকে। বহিরাগত ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা মৎস্যজীবী সংগঠনের নামে কেবল হাওর নয়, নদী পর্যন্ত ইজারা নেওয়ার মতো বাহাদুরিও করছে হাওর এলাকায়। যেমন, একটি ২০ একর বা তার ওপরের হাওর-জলাভূমি বিল (সরকারের ভাষায় যা জলমহাল) ইজারা দিয়েছে সরকার। 

ওই বিলের সীমানা হেমন্তকালে ২০ একর হলেও বর্ষাকালে প্লাবনে ভেসে যায় চারদিক। আর কোনো সীমানা থাকে না জলাভূমির। ২০ একরের ভেতরের মাছসহ সব জলজ প্রাণ ‘সীমানা লঙ্ঘন’ করে। ইজারাদার বাদে যদি গ্রামের কোনো দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক বা জেলে বা যে কেউ এই ভাসান পানিতে মাছ ধরতে যায়, তবে তাকে ভয়াবহভাবে জখম হতে হয়। ইজারাদার তাকে বাধা দেয় এবং ভাসান পানিতেও তাকে মাছ ধরতে দেওয়া হয় না। তখন আর ইজারাদার তার সীমানাকে ২০ একর হিসাবে চিহ্নিত না করে ভাসান পানিতেও তার মাছ ভেসে গেছে বলে ওই মাছ না ধরার ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করে। ধানের আবাদ না করলে যেমন হাওরবাসীর চলে না, তেমনি মাছ না ধরলেও হাওরবাসীর চলে না। 

বরুণ রায় ভাটিবাংলার বরুণ ফলের ভেতরের সেই আহাজারি টের পেয়েছিলেন। তাই বরুণ ফলের মতো তিনিও সঙ্গী হয়েছিলেন ভাসান পানির। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ভাসান পানির অধিকারের দাবিতে সংগঠিত এক গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বরুণ রায়। হাওরাঞ্চলে আশির দশকে বরুণ রায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার আন্দোলন।

আইনগত স্বীকৃতি ছাড়াই ব্যপকবিস্তৃত ও সক্রিয়  গণসমর্থন অর্জন করে ভাসান পানি আন্দোলন। সবকিছু পক্ষে থাকার পরও একসময়  ঝিমিয়ে পড়ে ভাসান পানি আন্দোলন এবং অনেকের মতে, 'মারাই যায়'। নেতৃত্ব শূন্যতা, মৎস্যজীবিদের ইজারাদার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সমর্থন, নেতাদের ইজারাদাররূপে আভির্ভাবসহ বিভিন্ন কারণেই আন্দোলনটি বন্ধ হয়ে যায়। আর একজন বরুন রায় সবাইকে হারিয়ে একা হয়ে পড়েন। কিন্তু বরুণের মৃত্যু নেই। 

নব্বইয়ের দশকে সীমিত পরিসরে  সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, মধ্যনগর, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জে আবারও ভাসান পানি আন্দোলন গড়ে উঠে। এর নেতৃত্বে ছিলেন ধর্মপাশার বাদশাগঞ্জের কৃষক নেতা খায়রুল বসর ঠাকুর, শাহজাহান কবীর, তাহিরপুরের আইয়ুব উদ্দিন শরীফ প্রমূখ। বিংশ শতাব্দীর শেষ সময়ে তাদের নেতৃত্বে আন্দোলনটি আবারও প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিক্রিয়াশীলদের অপকৌশলের কাছে হেরে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত আন্দোলন হটকারিতায় রূপ নেয়।এতে ব্যাপক প্রানহানির ঘটনা ঘটে। 

ঊনিশো আটান্নব্বই সাল থেকে  দুই হাজার সাল এই তিন বছরে ইজারাদারের হাতে প্রান হারায় অন্তত আটজন আন্দোলনকর্মী। এরপর মামলা-মোকদ্দমা মোকাবিলা করতে গিয়ে  আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্ব অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ে। এ ভাবে হাওরাঞ্চলের গণমানুষের প্রথাগত অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আবারও ঝিমিয়ে পড়ে। আন্দোলন ঝিমিয়ে গেলেও ভাটিবাংলার বরুণের ডালে ডালে ঝুলে থাকা বরুণ ফলের ভেতর সেই সব স্মৃতিচিহ্নের দ্রোহের ঝাঁজ এখনো বিরাজমান।

হাওরের ভাসান পানি বরুণের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বসন্তেই ফুটবে ফুল, তারবাদে বর্ষাতে ডালে ডালে থোকা থোকা ফল। আর ফলের ভেতরেই থাকবে আগামীর সব অপ্রতিরোধ্য সম্ভাবনা। আবারও ভাটিবাংলায় বরুণের ফল থেকে গজাবে চিরঅম্লান বরুণেরা। অসাম্যের ইজারাদারি বাতিল করে ভাসান পানিতে হাওরের প্রান্তিক জনগণের অধিকার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই হবে। বরুণের বীজের ভেতর হাওর-ভাটির সেই দ্রোহের ব্যঞ্জনা নিরন্তর বিরাজমান। বরুণ রায় বীজের ভেতর সেই সম্ভাবনা ও আহাজারিকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। তাই  ভাসান পানির সঙ্গী বরুণ বৃক্ষের দিকে আজও হাত বাড়িয়ে আছে বঞ্চিত হাওর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App