এমসি কলেজে ধর্ষণকাণ্ডে ফের আলোচনায় ছাত্রলীগ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৯:১৬ এএম

অভিযুক্ত ধর্ষকরা।
নানা কারণে সবসময়ই আলোচনায় ছিল সিলেট ছাত্রলীগ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে খুনাখুনি, হোস্টেল পুড়িয়ে দেয়া, রাম দা নিয়ে মিছিল- এমন অনেক অপকর্মেরই হোতা ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটির সিলেটের কতিপয় নেতাকর্মী। নেতাদের এসব অপকর্মের কারণে একাধিকবার কমিটি বাতিল, স্থগিতের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে কেন্দ্রকে। তবে এতে দমে যাননি সিলেট ছাত্রলীগের টিলাগড় এলাকার নেতাকর্মীরা। এছাড়া করোনাকালীন সময়েও কলেজ ছাত্রাবাস খোলা রাখায় কলেজ কর্তৃপক্ষের সমালোচনায় মুখর সিলেটবাসী।
করোনাকালে যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ; ঠিক সেই সময়ই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনায় নিজেদের জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে সিলেটজুড়ে চলছে সমালোচনার ঝড়। ইতোমধ্যেই এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
এদিকে, ধর্ষণের ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য গণিত বিভাগের প্রধান আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩ সদস্যের কমিটি করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ২ প্রহরীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার ও ১ শিক্ষার্থীর ছাত্রাবাসের সিট স্থায়ীভাবে বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার বিকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার এক নব দম্পতি এমসি কলেজ এলাকায় ঘুরতে যান। সন্ধ্যা হয়ে এলে স্ত্রীকে গাড়িতে বসিয়ে পার্শবর্তী দোকানে যান তার স্বামী। এ সময় ছাত্রলীগের ৫-৬ জন নেতাকর্মী এসে গাড়িটিকে ঘিরে ধরেন এবং তরুণীর সঙ্গে কথা বলতে চান। তরুণীর স্বামী এগিয়ে এলে তাকে মারধর করে গাড়িসহ এমসি কলেজ হোস্টেলে নিয়ে যান তারা। সেখানে স্বামীকে গাড়িতে আটকে রেখে এমসি কলেজ হোস্টেলের ৭ নম্বর ব্লকের ১২ নম্বর কক্ষে নিয়ে গণধর্ষণ করেন স্ত্রীকে। পরে এলাকাবাসী খবর দিলে পুলিশ এসে রাত সাড়ে ৯টার দিকে তরুণী ও তার স্বামীকে উদ্ধার করা হয়। পরে গভীর রাতে ওই কক্ষ থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ কয়েকটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর বøকের ১২ নম্বর কক্ষটি হোস্টেল সুপারের জন্য বরাদ্দ থাকলেও ওই কক্ষটি ছাত্রলীগের কর্মী অভিযুক্ত সাইফুর রহমানের দখলে ছিল।
এ ঘটনায় গতকাল শনিবার তরুণীর স্বামী বাদী হয়ে একটি ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়- এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রনি, মাহফুজুর রহমান মাছুম, সাইফুর রহমান, অর্জুন, রবিউল ও তারেকসহ অজ্ঞাত আরো ৩-৪ জনকে। এদের সবাই সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের অনুসারী বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে মাহবুবুর রহমান রনির বাড়ি হবিগঞ্জে। তিনি এমসি কলেজে ইংরেজিতে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। একই শ্রেণিতে অধ্যয়নরত মাহফুজুর রহমান মাছুমের বাড়ি সিলেট সদর উপজেলায়। সাইফুর রহমানের বাড়ি বালাগঞ্জে, রবিউলের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। অর্জুনের বাড়ি জকিগঞ্জে এবং তারেক জগন্নাথপুরের বাসিন্দা।
এছাড়া অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাইফুর রহমানকে আসামি করে আরো একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। তবে মামলা হলেও এখনো এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন সিলেট মেট্রোপলিটান পুলিশের (এসএমপি) শাহপরান (রহ.) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, মামলা হয়েছে। গত রাত থেকেই অভিযুক্তদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। তবে এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।তবে তার অনুসারীদের এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা রিসিভ করেননি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকার।
এদিকে ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই সিলেটের বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে কঠোর সমালোচনা। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এমসি ও সরকারি কলেজের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী কলেজের সামনে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে টিলাগড়-শাহপরান সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকার পরও ছাত্রাবাস খোলা রাখেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তাদের প্রশ্ন, এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ অবগত থাকার পরও কেন ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয়া হয়নি। এ সময় শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান। অন্যথায় তারা আরো কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেন। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেন তারা।
এদিকে, পুরো ব্যাপারটিতে একরকম দায়সারা বক্তব্য কলেজ কর্তৃপক্ষের। কলেজ ছাত্রাবাসে শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ করা কক্ষ নিজেদের দখলে রেখেছিলেন তরুণীকে গণধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তবে সব জেনেও কলেজের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। উল্টো কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশকে অবহিত করেছেন কক্ষ উদ্ধারের জন্য। এছাড়া করোনাকালীন সময়েও কলেজ ছাত্রাবাস খোলা রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ আহমদ বলেন, আমরা শিক্ষকদের কক্ষ দখলের বিষয়টি জানতে পেরে শাহপরান (রহ.) থানা পুলিশকে অবহিত করি। এছাড়া কক্ষে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেই। এর বাইরে আমাদের আর কিছু করার ছিল না। তিনি আরো বলেন, অভিযুক্তরা সবাই কলেজের সাবেক ছাত্র। এ জন্য আমরা কলেজ থেকে তাদের বিরুদ্ধে একাডেমিক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে আমরা জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযুক্ত ছাত্রদের সনদ বাতিলের সুপারিশ করব।
অন্যদিকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) জ্যোর্তিময় সরকার পিপিএম বলেন, পুলিশের কাছে যদি কলেজ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করে থাকেন, আর পুলিশ যদি কোনো পদক্ষেপ না নেয়Ñ তাহলে কার গাফিলতি আছে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এদিকে এমন ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এমসি কলেজ শাখাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।