সিলেট নগরীর অপরিকল্পিত উন্নয়নে দুর্ভোগে নগরবাসী

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২০, ১০:৩৫ এএম

সিলেট নগরী
সিলেট সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে সিটি মেয়র কিছু ক্ষেত্রে প্রশংসা কুড়ালেও অপরিকল্পিত উন্নয়নে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। নগরীর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক কোনো পরিকল্পনা নেই বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগও উঠেছে। যখন যা মনে করছেন তাই করছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
সরকার উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ দেয়ায় নগরজুড়ে একসঙ্গে বছরব্যাপী চালাচ্ছেন উন্নয়ন কাজ। নগরীর গ্যাস, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ বিভাগের যখন তখন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে। দিনের পর দিন কাজ না করে ফেলে রাখা বা কাজ শেষে রাস্তায় কার্পেটিং না করায় জনগণ অতিষ্ঠ।
আবার অনেকে বলছেন, মেয়র উন্নয়ন বলতে রাস্তা সম্প্রসারণ ও ড্রেন নির্মাণকে বোঝাতে চেয়েছেন। ফুটপাত শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের চলাচলে অনুপযোগী। উন্নয়নের নামে তিনি পরিবেশবিরোধী বক্স-কালভার্ট নির্মাণ করছেন। এর জন্য অনেকে সমালোচনা করছে। হকারমুক্ত ফুটপাত করতেও তিনি ব্যর্থ। ফলে সিলেট হয়ে উঠছে অপরিকল্পিত নগরীতে।
নগরীর সবুজ প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। সুয়্যারেজ লাইনের পানি সরাসরি সুরমা নদীতে পড়ে দূষিত হচ্ছে পানি। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বল্প মূল্যে আবাসন ব্যবস্থা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও তিনি এখনো সফলতা দেখাতে পারেননি।
সিলেটে নেই নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হচ্ছে পরিকল্পনা ছাড়াই। সিটি করপোরেশনে নেই নগর পরিকল্পনাবিদ। ফলে সরকার এ বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে অতিদ্রুত নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাচনের আগে মাস্টার প্ল্যানের কথা বলা হলেও এ বিষয়ে মেয়রের ভ‚মিকা নেই। সিলেট সিটিতে নগর পরিকল্পনাবিদদের পাশ কাটিয়ে বিশিষ্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর পরামর্শ নেয়া হয়। তিনি সিটি করপোরেশনের উপদেষ্টা।
অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের ইঞ্জিনিয়ার সেকশনেও নেই দক্ষ জনবল। অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে এবং নজরদারির অভাবে পাস করা নকশা পরিবর্তন করে নগরীতে বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোও তৈরি হচ্ছে ইচ্ছেমতো। কোনো নিয়ম-নীতির ধারে কাছেও অনেকে নেই। রাস্তা সম্প্রসারণের কাজেও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, সিলেটে ৯৭০ কিলোমিটার ছড়া এবং ড্রেন রয়েছে। ৩৫০ কিলোমিটার ফুটপাত, ৬৬৮ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। নগরীর ছড়াগুলোতে ১০০ কিলোমিটার ছড়ার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে।
মেয়রের বক্তব্য, উন্নয়নের স্বার্থে সিলেটের জনগণ সামান্য দুর্ভোগ মেনে নিয়েছে। সবাই বাহবা দিচ্ছে এবং দুর্ভোগ প্রতিদিনই কমছে। আগামী ৩ মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে সব দুর্ভোগ। মাস্টার প্ল্যান ছাড়া অপরিকল্পিত উন্নয়ন সম্পর্কে মেয়র বলেন, ফুটপাত, রাস্তা, ড্রেন ও মোড়ের মনুমেন্ট সব পরিকল্পনা মতোই হচ্ছে। নগরীতে পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের কারণে যানজটে সময় নষ্ট হচ্ছে। তেমনি হাঁটাচলাও দায় হয়ে পড়েছে। এছাড়া রাস্তায় দিনের পর দিন নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা, খোঁড়াখুঁড়ি বা সংস্কার শেষেও ভাঙাচোরা অংশ মেরামত না করার অভিযোগ রয়েছে। সচেতন নাগরিকদের কেউ এ ব্যাপারে সন্তুষ্ট নয়।
সিলেট সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন দুর্ভোগের কারণে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের। একই রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজের দুর্ভোগ শেষ হতে না হতেই কালভার্ট নির্মাণের দুর্ভোগে পড়ছেন নগরবাসী।
আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবল টানার কাজ শেষ হওয়ার পরই আবার পড়তে হচ্ছে ড্রেন প্রশস্তকরণ কাজের ফাঁদে। এতে সচেতন নাগরিক সমাজ বিরক্ত। সিলেটের সচতন নগারিকদের অধিকাংশই উন্নয়ন কাজের প্রশংসা করলেও সমালোচনা করছেন পরিকল্পনাহীন উন্নয়নের।
শিবগঞ্জের বখতিয়ার বিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্র সামি কয়েকদিন পরপরই সর্দিকাশিতে ভুগছে। ডাক্তার বলেছেন, রাস্তার ধুলোবালির কারণে এটি হচ্ছে। তার বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম জানালেন, কিছু করার নেই। এ অবস্থাতেই চলছে আমাদের জীবন। একই রাস্তায় একটা প্রকল্প শেষ হতে না হতে শুরু হচ্ছে আরেকটি। এতে নাগরিক জীবন প্রায় স্থবির হওয়ার উপক্রম। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ প্রায় সর্বস্তরের মানুষ। ব্যবসা ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট ইইউ শহীদুল ইসলাম শাহীন বলেন, নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় নাগরিক সেবার বিষয়টির প্রাধান্য দেয়া হয় না। আমাদের বর্তমান সিটি মেয়র নতুন ফুটপাত তৈরি করছেন। এটা প্রশংসনীয়। তবে দেখতে হবে নিয়ম মেনে ফুটপাত তৈরি হচ্ছে কিনা। একজন অন্ধলোকও এই ফুটপাত ধরে হেঁটে যেতে পারে কিনা- সেটা ভাবতে হবে। ফুটপাতকে দখলমুক্ত রাখতে হবে।
সিনিয়র সাংবাদিক ইকরামুল কবির উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে বলেন, সিলেটের জনপ্রতিনিধিরা আধুনিক নগরায়নের চিন্তা-চেতনার মূল ধারার কাছে নেই। তাদের মধ্যে সুদূরপ্রসারী কোনো ভিশন নেই। তারা মনে করেন, বিল্ডিং আর রাস্তা সম্প্রসারণই হলো উন্নয়ন।
পরিবেশকর্মী আব্দুল করিম কিম বলেন, প্রকৃতি বাঁচিয়ে গাছ বাঁচিয়ে উন্নয়নের এই চিন্তাধারার মানুষ সারা বাংলাদেশেই নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সিলেটে ৫০% সবুজের আচ্ছাদন কমেছে। পয়েন্টগুলোতে বিশ্রি মনুমেন্ট নির্মাণ হচ্ছে। সিলেটে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কেন? বারবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি কেন? তবে ভিন্নমত দিয়েছেন সুজন সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, আমার মতামত অত্যন্ত পজিটিভ। উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। ইতোমধ্যে চৌহাট্টা থেকে কুমারপাড়া পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। এখন বেশ সুন্দর হয়েছে, যাতায়াত বা চলাচলে সমস্যা হচ্ছে না, বরং ভালো লাগায় মনটা ভরে যায়।