×

রাজধানী

মিলির পরিবর্তে ঢাকায় কেন ট্র্যাসি জ্যাকবসন

১৭ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি

Icon

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মিলির পরিবর্তে ঢাকায় কেন ট্র্যাসি জ্যাকবসন

ছবি : সংগৃহীত

   

বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাষ্ট্রদূতকে সরিয়ে দিল। আগামী ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তার আগে মার্কিন প্রশাসন তার রাষ্ট্রদূতকে কেন সরিয়ে দিল- এ নিয়ে ঢাকায় ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে ১৭ বছর আগের একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি করল মার্কিন প্রশাসন। কেন এই পুনরাবৃত্তি, তা নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ। প্রসঙ্গত, আট মাস আগে চীনে কর্মরত ডেভিড মিলিকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত পদে মনোনীত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার জানানো হয়, ডেভিড মিলির পরিবর্তে অন্তর্বর্তীকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হয়ে আসছেন ট্র্যাসি জ্যাকবসন।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, আট মাস আগে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে যার নাম ঘোষণা করা হয়েছিল তাকে আচমকা বাদ দেয়া হলো। পিটার হাসের পর তার উত্তরসূরি হিসেবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মনোনীত করেছিলেন চীনে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড মিলিকে। কিন্তু আট মাস পর এসে তার নামটি বাদ দেয়া হয়েছে। ডেভিড মিলিকে যখন বাংলাদেশের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনীত করা হয়েছিল, তার কারণ ছিল তিনি দীর্ঘদিন চীনে কাজ করছিলেন। চীনের রাজনীতিসহ অন্যান্য বিষয়ে মিলির বিস্তর অভিজ্ঞতা রয়েছে। একই সঙ্গে ভারত, চীন ও বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক রসায়নের ক্ষেত্রেও তিনি কাজ করতে বেশ পারদর্শিতার পরিচয় দিতে পারতেন মার্কিন প্রতিনিধি হিসেবে। কিন্তু তাকে বাদ দেয়ায় নানা ধরনের প্রশ্ন উঠছে। কেউ কেউ এখানে রহস্যের গন্ধও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এর জবাবে মার্কিন প্রশাসনের কাছ থেকে যে কথা জানানো হচ্ছে, সেটিও অনেকের কাছে একটি যৌক্তিক কারণ মনে হতে পারে। তবে কেন কথাটি জানাতে মার্কিন প্রশাসনের এতদিন লাগল- তাও একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ডেভিড মিলিকে মনোনীত করার পরও তাকে নিয়ে মার্কিন সিনেটে কোনো শুনানি হয়নি। এর ফলে চূড়ান্তভাবে তাকে আর বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে না।

প্রশ্ন উঠেছে, এবার কেন জ্যাকবসনকে নিয়োগ দিল মার্কিন প্রশাসন। জ্যাকবসন হলেন পেশাদার কূটনীতিক। তিনি বিশ্বের এমন কিছু দেশে কাজ করেছেন- ঠিক যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছে। সব মিলিয়ে জ্যাকবসন মামুলি কোনো কূটনীতিবিদ নন, অত্যন্ত পেশাদার; যিনি রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতি সব দিক থেকেই মার্কিন প্রশাসনকে সেবা দিয়ে গেছেন। ২০১৮ সালে তিনি অবসরে যান। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেয়ার আগ মুহূর্তে মার্কিন প্রশাসন অবসরে যাওয়া একজন কূটনীতিবিদকে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন বুঝিয়ে দিল, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের পররাষ্ট্রনীতি বদলে যেতে শুরু করেছে।

জানতে চাইলে কূটনীতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রদূত এম সাইফুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্ক ভালো না থাকায় নিয়মিত রাষ্ট্রদূত পাঠাননি জো বাইডেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। আবার মার্কিন প্রশাসনেও নতুন প্রেসিডেন্ট। জো বাইডেন বিদায়ের আগে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগও করতে পারবেন না। এজন্য অন্তর্বর্তী কালের জন্য ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিল মার্কিন প্রশাসন। এখানে কোনো রহস্য বা প্রশ্ন খোঁজা উচিত হবে না বলে জানান তিনি।

ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সূত্রগুলো জানিয়েছে, সব ঠিকঠাক থাকলে চলতি সপ্তাহে ট্র্যাসি জ্যাকবসনের ঢাকায় এসে দায়িত্ব নেয়ার কথা রয়েছে। ঢাকায় দায়িত্ব নেয়ার আগে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে তিনি গত বুধবার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসাদ আলম সিয়ামের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী মিয়ানমারের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ট্র্যাসি জ্যাকবসনের মতো একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিককে অন্তর্বর্তী সময়ে ঢাকায় বিশেষ দায়িত্বে পাঠানো হচ্ছে। জন হপকিনস ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী পেশাদার কূটনীতিক ট্র্যাসি জ্যাকবসন তুর্কমিনিস্তান, তাজিকিস্তান ও কসোভোয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে রাশিয়া, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও লাটভিয়ার মার্কিন দূতাবাসে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালে কূটনীতিক হিসেবে অবসরে যাওয়ার আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে উপনির্বাহী সচিবের পদে কাজ করেছেন। ২০২১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে অবসর থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা পদে ফিরিয়ে আনেন। ওই বছরই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে আফগানিস্তান-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের পরিচালক হন ট্র্যাসি জ্যাকবসন। এরপর তাকে ইথিওপিয়ায় দেড় বছরের জন্য ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। জো বাইডেন ইরাকে পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাকে মনোনীত করেন। গত বছরের জুনে ওই মনোনয়নের বিষয়ে মার্কিন সিনেটে শুনানি হলেও নিয়োগটি ঝুলে ছিল।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ঠিক ১৭ বছর আগে দুই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঢাকায় যাওয়া-আসার মাঝখানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কাকতালীয় হলেও ২০০৭ সালের মতো এবারো বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালনের সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব কিছু দিন পালন করবেন চার্জ দ্য এফেয়ার্স। ওই সময় ২০০৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস। কিন্তু ১৪ মাসের মাথায় হঠাৎই মার্কিন প্রশাসন তাকে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। ফলে তিনি বেশ তাড়াহুড়া করেই ঢাকা ছেড়ে যান। ২০০৮ সালের এপ্রিলে জেমস এফ মরিয়ার্টিকে পরের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেয়ার আগে ঢাকায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৯ মাস ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলেছিলেন গীতা পাসি। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। এখন অন্তর্বর্তী সরকার। গীতা পাসি যখন ঢাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন তখনো বাংলাদেশে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। ১৭ বছর পর ট্র্যাসি জ্যাকবসন যখন ঢাকায় আসছেন- তখনো বলা হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়া এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে যে সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে, সেই কাজে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন রয়েছে বলে আগেই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কেবল সংস্কার প্রক্রিয়া এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্যই ট্র্যাসি জ্যাকবসনকে পাঠানো হচ্ছে?

বিশ্লেষকরা আরো বলেছেন, ট্র্যাসি জ্যাকবসন বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু বোঝার চেষ্টা করছেন। এর মানে তিনি বেশ ভালো পড়াশোনা করেই বাংলাদেশে আসছেন। প্রশ্ন উঠেছে, কেন ট্র্যাসি জ্যাকবসন বাংলাদেশে আসছেন? ডেভিড মিলিও যেমন তেমনি জ্যাকবসনও জো বাইডেন প্রশাসনের বিশ্বস্ত ব্যক্তি। এক্ষেত্রে মিলিকে বাদ দিয়ে কেন জ্যাকবসন? এটুকু বলা যেতে পারে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়তো নীতিগত কিছুই পরিবর্তন হবে না। কিন্তু বুঝতে হবে, এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে যে হিসাব সেটিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলাদেশ অবধারিতভাবে মার্কিন প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

জানতে চাইলে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর ভোরের কাগজকে বলেন, ২০০৮ সালের সঙ্গে ২০২৫ সালের ঘটনা মেলানোর কোনো কারণ নেই। এটি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে এবং এখানে আমাদের স্বার্থ পরিপন্থি কোনো ঘটনাও নেই। তিনি বলেন, সেই সময়ও আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয়েছিলেন। জর্জ বুশের পরিবর্তে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। মার্কিন রাজনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ীই নিয়মিত রাষ্ট্রদূত না দিয়ে ঢাকায় চার্জ দ্য এফেয়ার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এবারো জো বাইডেনের পরিবর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তার শপথ নেয়ার আগে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ না দিয়ে চার্জ দ্য এফেয়ার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের বিষয়ে বা আমাদের কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ঘটনা খোঁজা ঠিক হবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ট্রাম্প শপথ নেয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া হয়তো খুব তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে না। তবে ভেতরে ভেতরে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ে কাজ চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় কদিন আগে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান ভারত সফর করে গেছেন। সেই সফরের সময় দিল্লির সঙ্গে হওয়া বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোথায় দাঁড়ায় সেটি এখন দেখার বিষয়। অপরদিকে, চীন কিন্তু নীরব হয়ে রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App