পথচারীর নির্বিঘ্নে যাতায়াতে পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই । গত ৭ বছরে চট্টগ্রাম নগরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫ শতাংশ পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি (বিআইজিআরএস) প্রকাশিত চট্টগ্রাম সিটি রোড সেফটি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৬৯ জন। এর মধ্যে পথচারীর সংখ্যা ৩১৩, অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ। পথচারীর হাঁটার জায়গা যা আছে তার অধিকাংশ বেদখল। ফলে বাধ্য হয়ে সড়কের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। মোড়গুলোতেও নেই পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা। তাই প্রাণ হাতে নিয়েই সড়ক পার হতে হয়। এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামের সড়কে দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যার মধ্যে বেশি পথচারী। সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ৩ বছরে সড়কে পথচারী মৃত্যু বেড়েছে ৬০ শতাংশ। বিপরীতে কোনো উদ্যোগ নেই নগর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)। 

চসিকের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম নগরে সড়ক আছে ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার। বিপরীতে ফুটপাত আছে মাত্র ২৮১ কিলোমিটার; যা মোট সড়কের মাত্র ১৯ শতাংশ। এর মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ দখলে। এমনকি ফুটপাতে দোকানও বরাদ্দ দিয়েছে সিটি করপোরেশন।

২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সড়কে পথচারী মৃত্যুর হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ৩ বছরে পথচারীর মৃত্যু আরো বেড়েছে। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫৪ পথচারী। ২০২২ সালে ৬০ জন। ২০২৩ সালে ৫৬ জন। ২০২০ সালে নিহত হন ৩৩ জন। তিন বছরে (২০২১-২০২৩) সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৫৮ শতাংশ পথচারী। এছাড়া ২৭ শতাংশ মোটরসাইকেল এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও যাত্রী, ৮ শতাংশ চার চাকার যানবাহনের চালক ও যাত্রী এবং সাইকেল আরোহী ৭ শতাংশ। 

বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের ২০টি মোড় ও ১০টি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সিটি গেট, আউটার রিংরোডের খেজুরতলা, বারিক বিল্ডিং মোড়, সিঅ্যান্ডবি ও কালামিয়া বাজার মোড় সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ৩ বছরে এ মোড়গুলোতে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। রুটগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বিপজ্জনক বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত সড়ক। এই পাঁচ কিলোমিটার সড়কে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। 

নগরীতে পথচারীর জন্য কেন বেশি ঝুঁকি 

নগরীতে সড়কে পথচারীর মৃত্যু কেন বেশি, তার কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ বের করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ।

তাঁর মতে, চট্টগ্রামের সড়কগুলো পথচারীবান্ধব নয়। এখানে পথচারীর নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত ফুটপাত নেই; যা আছে তার মধ্যে কিছু অবৈধ দখলে, কিছু ভাঙাচোরা। তাছাড়া যেখানে দখলমুক্ত ফুটপাত আছে, সেখানেও অসমতল ও ধারাবাহিকতা নেই। বাধ্য হয়ে সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন পথচারীরা। মোড়গুলোতে যাত্রী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ট্রাফিকের হাতের ইশারায় যখন যানবাহন পার হয়, তখন গাড়ির ফাঁক গলে পথচারীরা সড়ক পার হন। আধুনিক কোনো ট্রাফিক ব্যবস্থাও নেই। গতিসীমাও নির্ধারণ করা নেই। পথচারীও অসচেতন।

তিনি আরো বলেন, সন্ধ্যায় ভারী যানবাহন চাপায় পথচারী নিহতের ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ এ সময় পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলো সড়কে নামে। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় পথচারীরা চাপা পড়ে মারা যান। এজন্য মোড়গুলোর আগে গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড হাম্প বসানো ও পথচারী আইল্যান্ড তৈরি করতে হবে।

চট্টগ্রামের ফুটপাত কাগজে-কলমে আছে, বাস্তবে নেই

চসিকের তথ্য অনুযায়ী, নগরে ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাত রয়েছে। বাস্তবে অধিকাংশ সড়কের ফুটপাতে চলাচলের সুযোগ নেই। হয়তো ফুটপাতগুলো সড়কের পাশের দোকানিরা দখল করে রেখেছেন, নয়তো হকারদের দখলে। স্বয়ং সিটি করপোরেশন নগরের বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে প্রায় ৩০০ দোকান বরাদ্দ দিয়েছে। 

সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর ১৭-২০ কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন। এ ফুটপাত কোথায় নির্মাণ করা হয়, তার কোনো বিবরণ নেই। ফলে প্রতিবেদনে ফুটপাত নির্মাণের কথা বলা হলেও, বাস্তবে তার দেখা মিলছে না।

চসিক সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছি। হকারদের জন্য হলিডে মার্কেট করা হবে। এরপর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। এছাড়া পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে।