
প্রিন্ট: ০৪ মে ২০২৫, ০৭:২৫ পিএম
স্লোগান ও পোস্টারে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৫৪ পিএম


অনেকের ধারণা মুক্তিযুদ্ধ শুধু পুরুষরাই করেছে, সেই ধারণা ভেঙে দেয় এই পোস্টারটি, ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’। এর মধ্য দিয়ে নারীরা যে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুইভাবে অবদান রেখেছেন তার নির্দেশনা পরিষ্কার।মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজের অবস্থান থেকে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অথবা সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও নিজের অবস্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। এই যে সবার স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ এর মূল কারণ কি? এর মূল কারণ হলো নিজের সত্তাকে টিকিয়ে রাখা, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, সর্বোপরি বাঙালির আপন নিশানা প্রতিষ্ঠা করা। সাধারণ মানুষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা এই যে সকলের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ অবদান বা আত্মত্যাগ বা দেশকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচানোর আকাক্সক্ষা, এই অবদান বা আত্মত্যাগ বা আকাক্সক্ষার পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধের গান, স্লোগান এবং পোস্টার। বিষয়টা একটু বিশদে বলি, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের সকল মানুষ যে একই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদ অনুভব করেছে তা কিন্তু নয়। বিভিন্নজন বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এরপর তাদের মনোবল টিকিয়ে রাখার জন্য সৃজনশীল বা সৃষ্টিশীল মানুষ গান তৈরি করেছেন, স্লোগান বানিয়েছেন, পোস্টারে নিজেদের অধিকারের কথা লিখেছেন। এই স্লোগান বা পোস্টারের ভাষা বা কথা এতটাই শক্তিশালী ছিল যার কারণে দেশের সকল মানুষ সেই স্লোগান দিয়ে বা পোস্টারের ভাষা বা লেখা পড়ে নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত শক্তি সঞ্চয় করেছে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের জনপ্রিয় তিনটি স্লোগানের মধ্যে একটি হলো ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর / বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ এই স্লোগানে মূলত কী আছে? এই স্লোগানে বাঙালির ঐতিহ্যের কথা বলা আছে। বাঙালি বীরের জাতি এটি বাঙালির ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য, তার জন্মভ‚মিকে স্বাধীন করার জন্য বলা হচ্ছে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর / বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ এই একটি স্লোগান নিজের মধ্যে এতটাই উদ্দীপনা নিয়ে আসে যে, কেউ চাইলেও ঘরে বসে থাকতে পারবে না। উদ্দীপনা তাকে রণাঙ্গনে নিয়ে যাবেই। মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি জনপ্রিয় স্লোগান হলো, ‘তুমি কে, আমি কে / বাঙালি, বাঙালি।’ এই স্লোগানে কী আছে? এই স্লোগানে আছে নৃ-তত্ত¡ বা নৃ-বিজ্ঞান। আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো, আমরা বাঙালি। এরচেয়ে বড় পরিচয় আমাদের নেই। পাকিস্তানিরা আমাদের একরকম জোর করে তাদের পরিচয়ে পরিচিত করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাঙালি তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল যে, তার আলাদা পরিচয়ের প্রয়োজন ছিল না। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় স্লোগানে বলা হয়েছে ‘তুমি কে, আমি কে / বাঙালি, বাঙালি।’ মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি জনপ্রিয় স্লোগান হলো, ‘তোমার আমার ঠিকানা / পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।’ এই স্লোগানের মাধ্যমে ভ‚গোলকে বোঝানো হয়েছে। মূলত, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। পুরো দেশে অসংখ্য নদ-নদীর শাখা, প্রশাখা বিস্তার লাভ করেছে। নদীর সাথে রয়েছে দেশের মানুষের ঐকান্তিক সম্পর্ক। সেই সময় দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নদীনির্ভর। নদীনির্ভর এই জাতিকে নিজের স্বরূপ, নিজের দেশের ভ‚গোল স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়েছে ‘তোমার আমার ঠিকানা / পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।’ মজার ব্যাপার হলো, এই তিনটি জনপ্রিয় স্লোগানের স্রষ্টা হচ্ছে ‘নিউক্লিয়াস’। এদের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদও বলা হতো। ১৯৬২ সালে তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। নিউক্লিয়াসের কাজ ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে যাবতীয় নীতি-কৌশল প্রণয়ন করা এবং স্বাধিকার আন্দোলনকে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া। সেই লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন রকম উদ্দীপনা এবং অনুপ্রেরণামূলক স্লোগান তৈরি করে। সিরাজুল আলম খান ছাড়াও এই সংগঠনের আরো দুইজন সদস্য ছিল আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এই তিনটি স্লোগানের বাইরে মুক্তিযুদ্ধে আরেকটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল তা হলো ‘জয় বাংলা’। উপরের তিনটি স্লোগান যেমন নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করে জয় বাংলা তেমনি এককভাবে কেউ সৃষ্টি করেননি। এই স্লোগানের ইতিহাস বেশ লম্বা। এই ইতিহাসটি অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তার এক লেকচারে তুলে ধরেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯। মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের সভা হচ্ছিল। আফতাব উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সূর্যসেন হলের ছাত্র। সভা চলাকালীন একপর্যায়ে তিনি হঠাৎ করে স্লোগান দিলেন ‘জয় বাংলা’। ঘটনার আকস্মিকতার রেশ কাটিয়ে উঠে ইকবাল হলের আরেক শিক্ষার্থী চিশতি শাহ হেলালুর রহমান, তিনিও চিৎকার করে বলে ওঠেন ‘জয় বাংলা’। ১১ জানুয়ারি ১৯৭০। সেদিন পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের একটি সভা ছিল। সেই সভায় একমাত্র বক্তা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মঞ্চের সামনের দিকে ‘জয় বাংলা’ লেখা একটি ব্যানার লেখা ছিল। বঙ্গবন্ধু আসার পথে ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান বেশ কয়েকবার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিলেন। তখনো পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নিজে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেননি। ৬ মে ১৯৭০। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছিল। সেদিন ছাত্রলীগের কর্মীরা একে অন্যকে সম্বোধন করছিল ‘জয় বাংলা’ বলে। ৭ জুন ১৯৭০। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের সভা ছিল। আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে সেই কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারীদের টুপিতে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো ছিল এই স্লোগানটি। এই সভায় বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম নিজ মুখে উচ্চারণ করলেন, ‘জয় বাংলা’। এরপর এই স্লোগান দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সকলের মাঝে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা রণধ্বনি হিসেবে ‘জয় বাংলা’ ব্যবহার করতো।
