×

সাময়িকী

শান্তি ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রেরণা

লালন সাঁই

Icon

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

 লালন সাঁই

বাউলের গান যে বাঙালির অন্তর্জগতে ঠাঁই করে নিয়েছে, তার মূলে রয়েছে লালন সাঁই ফকিরের (১৭৭৪-১৮৯০) অবদান। একটি অন্তর্মুখী মরমি সম্প্রদায়ের নিছক সাধন-সংগীত তার স্পর্শে পেয়েছে সংগীত-সাহিত্যের মর্যাদা। আজ প্রায় দুই শতাব্দী লালনের গান একদিকে যেমন বাঙালির মরমি-মানসের অধ্যাত্ম-ক্ষুধা, অপরদিকে তেমনি রস-তৃষ্ণা মিটিয়ে আসছে।

দুই.

কিন্তু এই আত্মনিমগ্ন সংসার-নির্লিপ্ত সাধকের জীবন-কাহিনি রহস্যে ঘেরা। তার জন্ম ও ধর্ম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। লালন নিজেও তার আত্মপরিচয় সম্পর্কে নীরব ও নিস্পৃহ ছিলেন। তার জীবনীর প্রামাণ্য উপকরণও আজ মেলা ভার। এর ফলে সেই ফাঁক পূরণ করেছে জনশ্রæতি ও অনুমান।

পলাশীর যুদ্ধের ১৭ বছর পর বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এক স্মরণীয় সন্ধিক্ষণে লালনের জন্ম। অনেকেরই ধারণা, লালন ফকির জন্মসূত্রে হিন্দু কায়স্থ পরিবারের সন্তান এবং তার জন্ম সেকালের নদীয়ার অন্তর্গত বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার অধীন কুমারখালী থানার ভাঁড়ারা গ্রামে। মাধব কর ও পদ্মাবতী তার জনক-জননী। তীর্থভ্রমণ বা গঙ্গাস্নানে গিয়ে উৎকট বসন্তরোগে আক্রান্ত জ্ঞানহীন লালনকে মৃত-বিবেচনায় তার সঙ্গীরা নদীতে ভাসিয়ে দেয় বা অন্তর্জলি করে। পরে এক মুসলমান তাঁতি তাকে উদ্ধার করেন এবং তারই আশ্রয়ে-যতেœ ও সেবায় লালনের আরোগ্য হয়। এরপর লালন ঘরে ফিরলে ‘যবন-সঙ্গদোষে’র কারণে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হন। ফলে সমাজ-সংসার-প্রত্যাখ্যাত লালনকে ঘর ছাড়তে হয়। পরে একসময় বাউলের দলে ভেড়েন এবং বাউলগুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা নেন। এরপর ছেঁউড়িয়ায় এসে আখড়া স্থাপন করেন এবং কালক্রমে তাকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে ওঠে ‘লালন-মণ্ডলি’- ‘সাধুর সাধবাজার’। লালনের নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা বঙ্গদেশে। ‘হিতকরী’ (৩১ অক্টোবর ১৮৯০) পত্রিকা জানাচ্ছে, ‘লালন ফকীরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকী নাই। শুধু এ অঞ্চলে কেন, পূর্ব্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেক দূর পর্য্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকীরের শিষ্য; শুনিতে পাই তাঁহার শিষ্য দশ হাজারের উপর।’ লালন তার সাধনপীঠ ছেঁউড়িয়াতেই ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর (১ কার্তিক ১২৯৭) দেহত্যাগ করেন। দীর্ঘজীবী লালন ১১৬ বছরের আয়ু পেয়েছিলেন।

এর বাইরে লালনজীবনী সম্পর্কে অপর মত হলো, লালন মুসলমান-সন্ততি, তার জন্ম বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু থানার হরিশপুর গ্রামে। তবে এই মতের সমর্থনে কোনো তথ্য-প্রমাণ বা যুক্তি নেই বলে তা ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বে সুধীজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।

তিন.

লালন সাঁই বাউল সাধনার সিদ্ধ পুরুষ। তার সাধনার ভেতর দিয়েই বাউলমতের সর্বোচ্চ বিকাশ। অতুলনীয় সংগীত-প্রতিভা ও তত্ত্বজ্ঞানের সমন্বয়ে লালন বাউল গানের একটি স্বতন্ত্র ‘ঘরানা’ নির্মাণ করেছিলেন। তার গানে বাউল-তত্ত্ব ও সাধনার গভীর পরিচয় মেলে। লালনের গানে দেহবিচার, মিথুনাত্মক যোগসাধনা, গুরুবাদ, মানুষতত্ত্ব- বাউল সাধনার এসব বিষয় সঙ্গতভাবেই এসেছে। বাউলের সাধনার মূল অবলম্বন মানবদেহ ও মানবগুরুর নির্দেশনা। তাই দেহজরিপ ও গুরুবন্দনাই রয়েছে বাউল সাধনার মূলে। দেহকে কেন্দ্র করেই বাউলের সাধনা। এই দেহের মধ্যেই পরম পুরুষের বাস। তাই দেহবিচারের মাধ্যমে আত্মস্বরূপ নির্ণয় করতে পারলেই সেই পরম প্রত্যাশিত ‘মনের মানুষে’র সন্ধান মেলে। লালনের গানে এই মানবদেহ কখনো ‘ঘর’, কখনো ‘খাঁচা’, আবার কখনো বা ‘আরশিনগর’ নামে অভিহিত হয়েছে।

চার.

বাউল গান বাংলার একটি প্রধান লৌকিক ধর্ম-সম্প্রদায়ের সাধন সংগীত। তাদের অধ্যাত্ম-সাধনার গূঢ়-গুহ্য পদ্ধতি কেবল দীক্ষিতজনের কাছে প্রচারের জন্যই এই গানের জন্ম। শিল্প-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। লালনও তাই বিশুদ্ধ শিল্প-প্রেরণায় তার গান রচনা করেননি, বিশেষ উদ্দেশ্য-সংলগ্ন হয়েই তার এই গানের জন্ম। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে অতিক্রম করে লালনের গান অনায়াসে শিল্পের সাজানো বাগানে প্রবেশ করেছে সমহিমায়। লালনের গান তাই একই সঙ্গে সাধন সংগীত, দর্শনকথা ও শিল্পশোভিত কাব্যবাণী। তত্ত্বসাহিত্যের ধারায় চর্যাগীতিকা বা বৈষ্ণব পদাবলি সাধন সংগীত হয়েও যেমন উচ্চাঙ্গের শিল্প-সাহিত্যের নিদর্শন, তেমনি বাউল গানের শ্রেষ্ঠ নজির লালনের গান সম্পর্কেও এই একই কথা বলা চলে।

দীর্ঘজীবী লালন প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে গান রচনা করেছেন। তার গানের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও অনুমান করা যায় তা অনায়াসেই হাজারের কোঠা ছাড়িয়ে যাবে। লালন ছিলেন নিরক্ষর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগই তার হয়নি। কিন্তু তার সংগীতের বাণীর সৌকর্য, সুরের বিস্তার, ভাবের গভীরতা আর শিল্পের নৈপুণ্য লক্ষ করে তাকে নিরক্ষর সাধক বলে মানতে দ্বিধা থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন স্বশিক্ষিত। ভাবের সীমাবদ্ধতা, বিষয়ের পৌনঃপুনিকতা, উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের বৈচিত্র্যহীনতা ও সুরের গতানুগতিকতা থেকে লালন ফকির বাউল গানকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তার সমকালেই তার গান লৌকিক ভক্তমণ্ডলীর গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষিত সুধীজনকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। উত্তরকালে লালনের গান দেশের ভূগোল ছাড়িয়ে পরদেশেও স্থান করে নিয়েছে। লোকপ্রিয় লালনের গান আজ সংগীত-সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে।

এই নিরক্ষর গ্রাম্য সাধককবির শিল্প-ভুবনে প্রবেশ করলে বিস্মিত হতে হয় যে, তিনি কত নিপুণভাবে শিল্পের প্রসাধন-প্রয়োগে রমণীয় করে তুলেছেন তার গানকে। ভাব-ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কার বিচারে এই গান উচ্চাঙ্গের শিল্প-নিদর্শন এবং তা তর্কাতীতরূপে কাব্যগীতিতে উত্তীর্ণ।

পাঁচ.

বাউল গান লৌকিক সমাজের অধ্যাত্মসাধনার অবলম্বন হলেও লালনের হাতে তা অধিকতর সামাজিক তাৎপর্য ও মানবিক বিশ্বাসে সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। লালনের গানে ধর্ম-সমন্বয়, সম্প্রদায়-সম্প্রীতি, মানব-মহিমাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা, বর্ণশোষণ-জাতিভেদ ও ছুঁতমার্গের প্রতি ঘৃণা, সামাজিক অবিচার ও অসাম্যের অবসান-কামনা- এসব বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। মূলত তার বিদ্রোহ প্রথার আনুগত্য, হৃদয়হীন শাস্ত্রাচার ও প্রচলিত সমাজধর্মের বিরুদ্ধে। এসব বক্তব্যের ভেতর দিয়ে তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবতাবাদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। আন্তরিক বোধ ও বিশ্বাসকে অকপটে লালন তার গানে প্রকাশ করেছেন। তার আদর্শ ও জীবনাচরণের সঙ্গে তার বক্তব্যের কোনো অমিল হয়নি- বিরোধ বাধেনি কখনো।

লালনের গান মানব-বন্দনা ও মানব-মহিমারও গান- যেমন এই গানটি :

অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই

শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই

দেব-দেবতাগণ করে আরাধন

জন্ম নিতে এই মানবে \

সাধন-ভজনের পথ-নির্দেশের জন্যে দেব-দেউল কিংবা কোনো প্রত্যাদেশ নয়, মর্ত্যরে মানবগুরুকেই লালন ধ্রæবতারা মেনেছেন। দুর্লভ মানব-জনমের গুরুত্ব, মানবমুখীন চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ এভাবে লালনের গানে জয়ী হয়েছে। এ দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে জাতিভেদ ও ছুঁতমার্গের অস্তিত্ব ছিল দুষ্টক্ষতের মতোই। এই কুপ্রথা ও কুসংস্কার ধর্মকে আশ্রয় করে সমাজজীবনে শক্ত আসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। মানুষের মনে এই সংস্কার ও ভেদবুদ্ধি এমন গভীর ছাপ ফেলেছে যে সহজে ও সমূলে এর উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। লালন এই অপশক্তির বিরুদ্ধেই আজীবন লড়াই করেছেন। লালন জানতেন, শুদ্ধ সাধনভক্তির জোরে অবজ্ঞাত তন্তুবায় কবির ও অস্পৃশ্য চর্মকার রামদাস মহাসাধকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাই তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে :

ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।

হিন্দু কি যবন বলে তার জাতের বিচার নাই \

লালন জীবনভর জাতিভেদ, ছুঁতমার্গ ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম করে এসেছেন। তার নিজের জীবনেও এই ধরনের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে অনেকবারই। প্রথম জীবনে মুসলমানের গৃহে অন্ন-জল-আশ্রয় গ্রহণের জন্য লালনকে শুধু সমাজচ্যুতই হতে হয়নি, স্নেহময়ী জননী ও প্রিয়তমা পতœীকেও হারাতে হয়েছে। এসব নির্মম ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো তার ভেতরে গড়ে উঠেছিল একটি প্রতিবাদী সত্তা। লালন তাই কখনোই জাতিত্বের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি। একজন মানবপ্রেমী সংস্কারমুক্ত বাউল হিসেবে তিনি জানতেন, জাতের সীমাবদ্ধতা মানুষকে খণ্ডিত ও কূপমণ্ডূক করে রাখে। তাই জাতধর্মের বিরুদ্ধে চরম বক্তব্য পেশ করে তিনি বলেছেন :

জাত না গেলে পাইনে হরি

কি ছার জাতের গৌরব করি

ছুঁসনে বলিয়ে।

লালন কয় জাত হাতে পেলে

পুড়াতাম আগুন দিয়ে \

ছয়.

লালন-আবিষ্কারের কৃতিত্ব মূলত রবীন্দ্রনাথের। যদিও তার আগে কেউ কেউ লালনের গান ও জীবনী প্রকাশ করেছেন। কিন্তু যথার্থ অর্থে রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যেই বাঙালি সমাজে লালন সম্পর্কে কৌতূহল ও আগ্রহ জাগে। তাই এই মরমি সাধকের পরিচয়ের পরিধি প্রসারে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথম লালনের গানের উল্লেখ করেন ভাদ্র ১৩১৪-তে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তার ‘গোরা’ উপন্যাসে। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’- এই একই গানের প্রথম দুটি পঙ্ক্তির উল্লেখ মেলে ‘জীবনস্মৃতি’ (১৩১৯) গ্রন্থের ‘গান সম্বন্ধে প্রবন্ধ’ অধ্যায়ে। এরপর ১৩৩২ সালে ‘ভারতীয় দর্শন সঙ্ঘে’র সভাপতির ভাষণেও এই ‘অচিন পাখি’র গানের উল্লেখ করে এর সঙ্গে তুলনা করেন ইংরেজ-কবি শেলীর একটি কবিতার। জমিদারি কাজে ‘পদ্মা-প্রবাহ-চুম্বিত’ শিলাইদহে বাসের সময়ে রবীন্দ্র্রনাথ ছেঁউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের দুটি খাতা সংগ্রহ করেন, যাতে সব মিলিয়ে ২৯৮টি গান ছিল। ১৩২২ সালের আশ্বিন থেকে মাঘ পর্যন্ত চার কিস্তিতে ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ‘হারামণি’ বিভাগে রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালনের মোট কুড়িটি গান প্রকাশিত হয়। এরপর ১৩৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত ‘ছন্দের প্রকৃতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে, যা পরে ‘ছন্দ’-গ্রন্থে সংযোজিত হয়, রবীন্দ্রনাথ লালনের তিনটি গান উদ্ধৃত করে এর ছন্দ-সুষমার প্রশংসা করেন। এছাড়া ‘জবষরমরড়হ ড়ভ গধহ’, ‘অহ ওহফরধহ ঋড়ষশ-জবষরমরড়হ’ কিংবা ‘মানুষের ধর্ম’-বিষয়ক বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ যে মরমি দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা করেছেন, তার মূলেও ছিল লালনীয় তত্ত্ব-দর্শনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব।

লালনের সংগীত ও দর্শন রবীন্দ্রমানসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তার ‘রবীন্দ্রবাউলে’ রূপান্তরিত হওয়ার পেছনেও ছিল লালনের প্রভাব। লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ গানটি রবীন্দ্রনাথের ভাবজগতে পরিচালিকা-শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ‘কে কথা কয় রে, দেখা দেয় না’- লালনের এই গানের ভাব-সত্যকে তিনি তার ‘রাজা’ নাটকে রূপায়িত করেছেন। বাউল গান, বিশেষ করে লালনের গান রবীন্দ্রমননে যেমন তার গানেও তেমনি স্পষ্ট ছাপ ফেলেছে- প্রেরণা হয়েছে অনেক কবিতার। অনেক ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের বাউলাঙ্গের গানে লালনগীতির কথা ও সুরের প্রভাব ও সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া কষ্টকর নয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শক্তিমান, সচেতন, অসামান্য এক শিল্পী-পুরুষ। তাই তিনি লালনের বাণী ও সুরকে ভেঙে ‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’ নতুনভাবে নির্মাণ করেছেন, যা একান্তই ‘রবীন্দ্রবাউলে’র রচনা। তবে এ কথা বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের মরমি-মানসে লালন ছিলেন প্রেরণার এক স্বতঃস্ফূর্ত উৎস।

সাত.

লালনের পরিচয় ও প্রতিষ্ঠার পরিধি আজ দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বের মানচিত্রকে স্পর্শ করেছে। ইউনেস্কো ২৫ নভেম্বর ২০০৫-এ বাংলাদেশের বাউল গানকে ‘ধ গধংঃবৎঢ়রবপব ড়ভ ঃযব ঙৎধষ ধহফ ওহঃধহমরনষব ঐবৎরঃধমব ড়ভ ঐঁসধহরঃু’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বলাই বাহুল্য, এর মূলে রয়েছে লালনের গান। সঙ্গত কারণেই তার প্রতি বাইরের জগতের মনোযোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশে বাউল ও লালন সম্পর্কে আগ্রহ ও অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায় চার্লস ক্যাপওয়েল, এডওয়ার্ড সি. ডিমক, জোসেফ কুকার্জ, জুনে ম্যাকড্যানিয়েল, ক্যারল সলোমন, মাসাউকি ওনিশি, জান ওপেন শ’, মাসাহিকি তোগাওয়া প্রমুখের রচনায়। অদূর ভবিষ্যতে বহির্বিশ্বে লালন বাংলাদেশ ও বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রতিনিধি-ব্যক্তিত্ব হিসেবে গৃহীত হবেন সে সম্ভাবনা ক্রমশ স্পষ্ট ও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

আট.

লালনের জন্মের পর ২৪৯ আর মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ১৩৩ বছর। তবু আজও লালন সমান প্রাসঙ্গিক ও আধুনিক। তার গান বাউলসমাজের সাধনার উপকরণ হিসেবে যেমন বিবেচিত, তেমনি সংগীতরসিকের মরমি চিত্তকেও আলোড়িত করতে সক্ষম, পাশাপাশি সমাজভাবনার অনুষঙ্গেও তা মূল্যবান। সম্প্রতি প্রয়াত লালন-গবেষক ডক্টর ক্যারল সলোমন একবার এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘লালন যে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী, সে ম্যাসেজটা বেশ কয়েকটা গানে পাওয়া যায়।... আবার বেশকিছু গান আছে যা গোঁড়ামি এবং সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। লালন বিশ্বাস করেছিলেন যে, মানুষ শ্রেষ্ঠ। তা হলে দেখা যায় যে, লালনের গানে বিশ্ব-মানবমৈত্রীর উপকরণ আছে’ (‘মনের মানুষের সন্ধানে’, আবুল আহসান চৌধুরী, ঢাকা, ১৯৯৫; পৃ. ১২৫)। আজ সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদের উত্থানের কালে- মনুষ্যত্ব-মানবতার লাঞ্ছনার সময়ে- সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের বৈরী যুগে লালনের গান হতে পারে প্রতিবাদের শিল্প- শান্তি ও শুভবুদ্ধির প্রেরণা- মানুষের প্রতি হারানো বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার পরম পাথেয়। আলেক সাঁই।

- আবুল আহসান চৌধুরী

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

ইরানের সঙ্গে পেরে না উঠে যুক্তরাষ্ট্রকে ডাকছে ইসরায়েল!

ইরানের সঙ্গে পেরে না উঠে যুক্তরাষ্ট্রকে ডাকছে ইসরায়েল!

দিনে বিএনপি রাতে আওয়ামী লীগ করেছে এমন লোকদের সদস্য পদ নবায়ন হবে না: আমিনুল হক

দিনে বিএনপি রাতে আওয়ামী লীগ করেছে এমন লোকদের সদস্য পদ নবায়ন হবে না: আমিনুল হক

ওজন কমায় যে ৩ ডাল

ওজন কমায় যে ৩ ডাল

আমি তো শাশুড়ি হয়ে গেছি: শ্রাবন্তী

আমি তো শাশুড়ি হয়ে গেছি: শ্রাবন্তী

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App