×

বিশেষ সংখ্যা

মরিয়ম সেঁজুতি

বছরজুড়ে টালমাটাল অর্থনীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস

Icon

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বছরজুড়ে টালমাটাল অর্থনীতি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস
   

বছরের শুরুতে অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রে ছিল রিজার্ভ-সংকট। এর সঙ্গে উদ্বেগ তৈরি করে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ। চলমান এ সংকটে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায় হু হু করে। এক যুগের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠে যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ডলারের অস্থিরতা, রাজস্ব ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাসহ নানা সমস্যা। জুলাই-পরবর্তী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে, ফলে অর্থনীতিও একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আগের গৎবাঁধা উদ্যোগ নেয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আসেনি; অর্থাৎ পটপরিবর্তনের ডামাডোলে চাল, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে চলতি বছরে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমেনি, বরং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এরপরও নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা ফিরেছে, প্রবাসী আয়েও সুবাতাস বইছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী বছরের মূল চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক দিক থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। সেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতিই বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন- দেশের আর্থিক খাতের ‘কষ্টকর বছর ছিল’ ২০২৪।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ২০২৪ সাল কষ্টকর বছর ছিল। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি শুরু থেকেই চাপের মধ্যে ছিল। বছরশেষে তা আরো বেড়েছে। একটি বিশাল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। আন্দোলনের সময় অর্থনীতির চাকা একেবারেই থেমে গিয়েছিল। বিশেষ করে শহর অঞ্চলের শিল্প খাত, সেবা খাত অর্থনীতি। মূল্যস্ফীতি আগে থেকেই বাড়ছিল। বছরশেষে তা আরো বেড়েছে। আন্দোলনের সঙ্গে প্রকৃতিক দুর্যোগও যুক্ত হয়েছে।

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনীতি চালু রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য যেসব খাত রয়েছে যেমন- আর্থিক খাত, জ¦ালানি খাত। এসব আর্থিক খাতের দুর্দশা আরো ঘনীভূত হয়েছে। পরিবর্তনের আগে যেসব বিষয় লুকোচুরি করা হতো- আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তা প্রকাশ পাচ্ছে। আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো অল্প সময়ের জন্য নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগেছে। নতুন নেতৃত্ব আনা হয়েছে। ব্যক্তি খাতের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করা হয়েছে। এরপরেও সেখানে অস্থিরতা কমেনি। ড. জাহিদ বলেন, ব্যাংকেং খাতে তারল্য-সংকট আরো বেড়েছে। মূলধন ঘাটতি এখনো ব্যাপক আকার আছে। কিছু কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সাময়িকভাবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু রোগ সারতে যেসব পথ্যের প্রয়োজন তা প্রক্রিয়াধীন। জ¦ালানি খাতে সরবরাহ পরিস্থিতি সামাল দেয়া হচ্ছে কিন্তু আর্থিকভাবে জ¦ালানি খাত সরকারের বাজেটের ওপর একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারেও ইদানীং চাপ বেড়ে গেছে। রিজার্ভের অবস্থা এমনিতেই দুর্বল ছিল। মাঝে কিছুটা স্বস্তি এসেছিল। কিন্তু ইদানীং আবার একটু অস্থিতিশীল দেখা যাচ্ছে। ফলে রিজার্ভের যে সমস্যা ছিল সেখান থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় রাজস্ব আদায়ের বড় লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি যাওয়াও সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে। যদিও বাজেট কাটছাঁট করা হচ্ছে।

এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে খাদ্যমূল্যস্ফীতিতে শুধু মূল্যস্ফীতি কমালেই হবে না, মূল্যটাও কমতে হবে। সেজন্য বাজেট থেকে যেন আর অতিরিক্ত চাপ না আসে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অবস্থান থেকে সরে আসা যাবে না। যদিও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক ক্ষোভ রয়েছে। এছাড়া দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে, কিন্তু খুব একটা বাড়ছে না বা প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ এর মধ্যেও প্রবৃদ্ধি থাকলে অবস্থার প্রেক্ষাপটে ভালো অর্জন হবে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে।

জাহিদ হোসেন বলেন, ইতিবাচক দিক হচ্ছে, অর্থনীতির আয়ের অন্যতম দুটি উৎস যেমন- রপ্তানি ও রেমিট্যান্স, দুটোই বেশি আসছে। এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে একটি বড় রকমের রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। এ পরিবর্তন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি, একটি বড় রকমের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হয়েছে। ফলে অর্থনীতিতেও একটি বড় ঝাঁকুনি খেয়েছে। এ পরিবর্তনের আগে জানুয়ারি থেকে জুলাই সময়কালেও আগের বছরের ধারাবাহিকতায় অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ, ডলারের বিপরীতে টাকার মান নিয়ে, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা নিয়ে- বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জ ছিল। এর মধ্য দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। বর্তমান সরকার তড়িৎ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়ার ফলে আমরা বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখেছি। একইভাবে জ¦ালানি খাতের অব্যাহত চ্যালেঞ্জগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে দেখেছি। এ উদ্যোগগুলো সবাই ভালোভাবেই নিয়েছেন। কিন্তু বিপরীতে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ নিতে দেখেছি সেটা গৎবাঁধা আগের মতোই। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ সে অর্থে কমেনি; বরং বেড়েছে। এ সময়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। বিশিষ্ট এ গবেষক বলেন, একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের সেসব কার্যক্রম এখনো চলমান। সেই সমস্ত সংস্কার কার্যক্রম নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার নির্বাচনের আগে কী কী পদক্ষেপ নিতে পারেন তা হয়তো আগামী বছরে দৃশ্যমান হবে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বিদায়ী বছরে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে গতি পায়নি, যা সরকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। যদিও সরকার ব্যয় সাশ্রয়ের দিকে এগিয়েছে। এ উদ্যোগ যৌক্তিকভাবেই দেখছি। এগুলো ইতিবাচক বলে মনে হয়েছে।

ড. মোয়াজ্জেম বলেন, বেসরকারি খাতের ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ এখন পর্যন্ত ফেরেনি, বরং পুরনো যেসব কার্যক্রম চলছে সেখানেও একধরনের স্লোথগতি দেখা যাচ্ছে। এসএমই খাতগুলো ঢুকছে কিছুক্ষেত্রে। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া, এলসি খোলা, গ্যাস-সংকট, উৎপাদন ব্যায় বেড়েছে, ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। সবকিছু নিয়ে বলা যায় অর্থনীতির বিচারে বছরটি ভালো যায়নি। একটাই আশার দিক থাকতে পারে, সংস্কারের জন্য যে কমিশনগুলো করা হয়েছে, তাদের দিক থেকে যে সমস্ত প্রস্তাব আসবে- সে প্রস্তাবনার নিরীখে কিছু উদ্যোগ শুরু করতে পারা, এবং তার আলোকে যদি নতুন বছরে কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে- এমনটাই আশা করছে মানুষ।

২০২৪ সালের অর্থনীতি কেমন ছিল, থাকছে সালতামামিতে-

মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা : ২০২৪ সালজুড়েই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ বছরে দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে নির্ধারিত ও স্বল্পআয়ের মানুষকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। বিষয়টি বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারও ডিম, আলু, পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে এবং বিভিন্ন পণ্যে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে। তারপরও দাম কমেনি। চাল, আটা, পেঁয়াজ, মরিচ থেকে শুরু করে বছরের শেষ সময়ে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধি ভুগিয়েছে ভোক্তাদের। ডিমের দাম বেড়ে ১২৫-১৫০ টাকা ডজন ঠেকে।

জুলাই ও আগস্ট মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসংযোগ শুরু হলে পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়ে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৪ শতাংশে পৌঁছে। এমনকি সরকার চাল, পেঁয়াজ, আলু, ডিম আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করার পরও কমেনি এসব পণ্যের দাম। গত নভেম্বরেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশের রেকর্ড করেছে।

ব্যাংক খাতে আমানতকারীদের উৎকণ্ঠায় বছর পার : ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম, খেলাপি ঋণ, নামে-বেনামে ঋণের মাধ্যমে অর্থ লুটপাটের কারণে দেশের ব্যাংক খাতে ২০২৪ সালে দেখা দেয় তারল্য-সংকট। চাহিদা অনুযায়ী আমানতকারীদের অর্থ দিতে ব্যর্থ হয় তারল্য-সংকটে পড়া ব্যাংকগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে সংকট কাটানোর চেষ্টা করে। ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ও আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ও তাদের আস্থা ফেরাতে শুরুতেই ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টার হয়ে তারল্য-সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংক থেকে অর্থের জোগান দেয়া হয়। এমনকি টাকা ছাপিয়েও সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে দেয়া হয়েছে। ফলে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে সংকট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে। রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক ঋণ এ খাতের সংকট তীব্র করেছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের সমস্যাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বীকৃত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। পুনঃতপশিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ ২ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণ অবলোপন হয়েছে ৭৫ হাজার কোটি টাকার।

আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ, প্রধান ঝুঁকিগুলো নিরূপণ করতে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথকীকরণ- সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে ব্যাংক খাতের টাস্কফোর্স। এদিকে ব্যাংকিং খাত সংস্কার টাস্কফোর্স থেকে ‘দ্য স্পেশাল রেগুলেশনস অব বাংলাদেশ ব্যাংক-২০২৪’ নামে একটি নীতিমালা জারি হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়নে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিতে পারবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ মূল্যায়ন করে প্রকৃত মূলধনের প্রয়োজনীয়তা বের করা এবং দুর্বল হওয়া ব্যাংকের অবস্থার উন্নয়ন করাই এই পরামর্শক নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য।

ডলারের বিনিময় হার : ২০২৪ সালের শুরু থেকেই ডলারের বিনিময় হারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়। বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর ডলারের বিনিময় বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়, তাতে ডলার বিনিময় কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা যায়। তবে শেষ সময়ে আবার অস্থির হয়ে ওঠে ডলারবাজার।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে ডলারের দর বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়, সর্বশেষ জুলাইয়ে ডলারের বিনিময় হার ছিল ১১৮ টাকা। ডলারের জোগান দিতে গিয়ে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অস্থিরতা অনেকটা কেটে যায়। তবে বছরের শেষ মাসে পাঁচ মাস বিরতির পর টাকার বিপরীতে ডলারের দাম আবার বাড়তে শুরু করে। যদিও ডলারের দাম নিয়ে নতুন অস্থিরতার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৩ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা

পরিচালকদের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো চিঠির প্রতিক্রিয়ায় একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, রমজানে নিত্যপণ্যের এলসির পাশাপাশি পুরনো এলসির কারণে মুদ্রাবাজার চাপে আছে। কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভ ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনার প্রক্রিয়া ও কয়েকটি বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসও ডলারের দাম বাড়ার পেছনে দায়ী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডলার ও ডলারের বিনিময় হার আরো নমনীয় হতে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো প্রতিদিনের দামের ভিত্তিতে ডলারের জন্য রেফারেন্স রেট প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য রেফারেন্স রেটকে ডলার কেনাবেচার হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা।

রেমিট্যান্স প্রবাহ : বছরের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে রেমিট্যান্সে বড় ধরনের ভাটা পড়েছিল। আগস্ট-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেকটাই বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে দেশে এক হাজার ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। জুলাইয়ে রেমিট্যান্স ২০০ কোটি টাকার নিচে আসলেও আগস্ট থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। আগের বছর একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৮৭৯ কোটি মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, ডিসেম্বর মাসের ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স এসেছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।

রপ্তানি আয়ে সুবাতাস : নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০২৪ সালে রপ্তানি আয়ে ঊর্ধ্বমুখী ভাব বজায় ছিল। অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি খাতের আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর আগে সেপ্টেম্বরেও ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। দেশে ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ঘাটতি, ডলার-সংকট, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, শ্রমিক অসন্তোষ ও গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে যখন কারখানার নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত; তখন রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিক এই প্রবৃদ্ধির খবর নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য দারুণ উদ্দীপক বার্তা হিসেবে দেখেন বিশ্লেষকরা।

অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে কৃষি, ওষুধ, পোশাক, সিরামিক, চামড়াসহ পণ্য রপ্তানির ২৭ খাতের মধ্যে ১৯টিই বেড়েছে; অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। এর মধ্য দিয়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৪১৩ কোটি মার্কিন ডলার; যা ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ৩৪২ কোটি ডলার। অর্থাৎ অক্টোবরে ৭১ কোটি ডলার রপ্তানি আয় বেড়েছে; যা শতাংশ হিসাবে ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই বাড়ল রপ্তানি আয়।

গ্রীষ্মের জন্য পণ্য পাঠানোর শেষ মাস ছিল অক্টোবর। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে জুলাই-আগস্টে কম চালান হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, অক্টোবরে আটকে থাকা পণ্য পাঠানো হয়েছিল, যা রপ্তানি আয়কে তীব্রভাবে বাড়িয়েছে। তবে প্রবৃদ্ধির প্রবণতা সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য আগামী কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, পোশাক খাতে অস্থিরতা ছিল এবং ক্রেতারা কাজের অর্ডার দিতে ধীরগতিতে চলেছিলেন।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ : বছরের শুরুতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে দর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এতে রিজার্ভ তলানিতে নেমে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমেছে। ২২ ডিসেম্বর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের বিপিএম হিসাব অনুযায়ী তা ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।

খেলাপি ঋণ রেকর্ড : বিগত সরকারের আমলে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা খেলাপিতে পরিণত করেছে নামধারী ব্যবসায়ী ও কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ। বারবার নিয়ম পরিবর্তন করে খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখানো হতো। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে মোট বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা।

বছরজুড়ে পুঁজিবাজার : চলতি বছরে পুঁজিবাজারে ক্ষত আরো গভীর হয়েছে। কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারেনি পুঁজিবাজার। সংশ্লিষ্টরা বলেন, বছর শেষের দিকে হওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী সাইডলাইনে আছেন। নতুন বছরে পরিস্থিতি দেখে তারা আবার সক্রিয় হবেন। এমন অবস্থায় সূচকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে লেনদেনের পরিমাণ।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উল্লেখযোগ্য কোনো কোম্পানি আইপিও বা কিউআইওতে আসেনি, বরং অন?্যান?্য বছরের তুলনায় এ বছর পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুঁজিবাজারে গভীরতা বাড়াতে নতুন নতুন ভালো কোম্পানি আনতে হবে, যাতে বিনিয়োগকারীরা ইচ্ছামতো ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারেন। ভালো মৌল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে পুঁজিবাজারের ভিত্তি আরো শক্তিশালী হবে এবং গভীরতা আরো বাড়বে।

সম্প্রতি এক বক্তব্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, পুঁজিবাজারে অস্থিরতার পেছনে প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের অনেক দোষ আছে। তিনি আরো বলেন, আপনারা জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কিনছেন, যার কোনো অস্তিত্ব নেই, অথচ এ শেয়ার মহাআনন্দে কিনছেন। ন্যূনতম কোনো মূল্য নেই, এগুলো কয়েক দিন পরই ওয়েস্ট পেপার হিসেবে ব্যবহার হবে। এজন্য একটু কষ্ট করতে হবে। আমি বিনিয়োগকারীদের দায়ী করছি না। পুঁজিবাজারের প্লেয়ার ও রেগুলেটরদের অনেক দোষ আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App