×

বিশেষ সংখ্যা

ড. আজিজুল আম্বিয়া

তবুও সুদিনের প্রতিক্ষায়...

Icon

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তবুও সুদিনের প্রতিক্ষায়...
   

দেশপ্রেম আর দেশ গড়ার শপথের মধ্যে শুরু হোক নতুন বছর। এই প্রত্যাশা নিয়ে এই সরকারের দিকে চেয়ে আছেন সারা বিশ্বের কোটি কোটি বাঙালি। তাই যারা দেশ চালাচ্ছেন তাদের জন্য অনেক কাজ বাকি রয়েছে। এজন্য অত্যন্ত গুরুত্ব ও সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যারা ৫ আগস্টের মাধ্যমে এদেশে একটি নতুন দিনের সূচনা করেছেন, তাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া রয়েছে। এসবের হিসাব-নিকাশ তারা সময় মতো বুঝে নেবেন। এই হিসাব যদি এই সরকার ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে না পারেন তাহলে হয়তো ওনাদের কপালে অনেক দুঃখ রয়েছে বলে গুণীজন মনে করেন। এ জন্য এই সরকারকে অনেক পরীক্ষা দিতে হবে আর অবশ্যই এসব পরীক্ষা তাদেরকে পাস করতে হবে এবং টিকে থাকতে হবে। গদিচ্যুত শেখ হাসিনা : নির্বাচনে জেতার আট মাসের মধ্যেই গদিচ্যুত হন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট শিক্ষার্থী-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছাড়েন মুজিবকন্যা। এরপর ৮ আগস্ট বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক এবং সেনাবাহিনী প্রধান দ্বারা নিশ্চিত করা হয়। এবং ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন করা হয়। বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিল অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার, গণঅভ্যুত্থানের ঠিক তিন দিনের মাথায় গঠিত সরকারের প্রতি তখন সাধারণ মানুষকে সমর্থন দিতে যেমন দেখা গিয়েছিল, তেমন প্রত্যাশাও ছিল বিপুল। সরকারের পক্ষ থেকেও আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তন আনাসহ নানান প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের এসব প্রতিশ্রæতির মধ্যে অনেকগুলোতেই তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানা যায় ‘বিশেষত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। ব্যর্থ বলার জন্য বিগত তিন মাস পর্যাপ্ত না হলেও একেবারে কমও নয়’, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন। যদিও উপদেষ্টারা বলছেন, একের পর এক আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যেও তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যার ফল আগামী তিন মাসের মধ্যেই পুরোপুরি দৃশ্যমান হবে। দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের পক্ষ থেকে যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে, সেটি হলো- রাষ্ট্র সংস্কার। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণেও প্রতিবার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মহাম্মদ ইউনূসকে। ‘জনস্বার্থের বিপরীতমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। আমরা এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎস হয়,’ গত ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে বলেন অধ্যাপক ইউনূস। সেদিনে ভাষণে তিনি আরো বলেছেন, ‘তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সফল আমাদের হতেই হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।’ গণঅভ্যুত্থানের এক মাসের মাথায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে সরকার। পরবর্তীতে এই তালিকায় নতুন আরো চারটি কমিশন যুক্ত করা হয়।

সেগুলো হলো : স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। ১০ খাতের কোনটিতে কী ধরনের সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে কমিশনগুলো। চলতি মাসের শেষে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সংস্কারকাজ শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার। তবে কতদিনের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ হবে, সে বিষয়ে এখনো সুস্পষ্ট কোনো সময়সীমা ঘোষণা করা হয়নি। রাষ্ট্র সংস্কারে কমিশন গঠনকে ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ হিসেবে সাধুবাদ জানালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এক্ষেত্রে সরকারের আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল। ‘শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষ দ্রুত কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু সরকার তাদের সেই আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেও কেউ কেউ সংস্কার প্রক্রিয়ায় ধীরগতির অভিযোগ তুলেছে। আবার বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলকে দ্রুত সংস্কার শেষ ও নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও তুলতে দেখা যাচ্ছে এবং তারা নির্বাচনের জন্য রাস্তায় নামারও হুমকি দিচ্ছেন। এদিকে উপদেষ্টারাও তার জবাব দিচ্ছেন। ‘এ অবস্থায় কতদিন ক্ষমতায় থেকে সরকার কী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র সংস্কার করতে চায়, সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এতে সরকারের সংস্কার কাজেও গতি আসবে বলে আমি মনে করি,’ বলেন নাসরীন। ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার পড়েছে, সেগুলোর একটি হলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না রাখতে পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের বড় ধরনের ক্ষোভ জন্মেছিল। আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম তো কমেইনি, বরং সবকিছুর দাম আরো বেড়ে গেছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার বাসিন্দা শায়লা সুলতানা। শায়লা সুলতানা ও তার স্বামী দুজনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ‘তারপরও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও বাজার খরচ চালাতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে,’ বলছিলেন শায়লা সুলতানা। একই কথা বলছিলেন আজিমপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম। ‘তাহলে এত আন্দোলন-সংগ্রাম করে হাসিনারে নামায়ে সাধারণ মানুষের কী লাভ হলো?’ বিবিসি বাংলাকে বলেন আমিরুল ইসলাম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। নতুন সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে টাকা না ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সরকার। এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাজারে সেটার প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি। এমনকি তেল, চিনিসহ আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত তিন মাসে, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ‘সোজা কথায়, গত তিন মাসে সরকার কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়নি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী। দ্রব্যমূল্য যে সহনীয় পর্যায়ে নেই, সেটি সরকারও স্বীকার করছে। ‘আমি মধ্যবিত্ত, নিজে বাজার করে খাই। আমি নিজেও মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে আছি,’ সাংবাদিকদের বলেন, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। সরকার বলছে, সাম্প্রতিক বন্যার কারণে কৃষিক্ষেত্রে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটিও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শিগগিরই চালসহ সবকিছুর দাম কমে আসবে বলেও আশা করছেন তারা। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা রীতিমতো নাজুক হয়ে পড়েছিল। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। এই সরকারের গত তিন মাসে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘যে উদ্যোগ থেকে সবচেয়ে বেশি ফলাফল দেখা যাচ্ছে সেটা বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। খুব একটা বেড়েছে তা না, তবে কমেনি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। রিজার্ভের ক্ষেত্রে তিন মাসে ভালো অর্জন দেখালেও সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বলে জানিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। ‘যেখানে ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না একেবারে, সেটা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে,’ বলেন জাহিদ হোসেন। দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতিও এই সময়ে সামান্যই কমেছে।

গত জুলাইয়ে যেখানে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল, সেটি অক্টোবরে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ হয়েছে। এদিকে ব্যাংক খাত সংস্কার ও অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে খেলাপি ঋণ ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ‘আপাতত ব্যাংক খাতের রক্তক্ষরণটাকে বন্ধ করা গেছে। তবে ডায়াগনোসিস এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি,’ বলছিলেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। ফলে টাকা উত্তোলনে সীমা নির্ধারণ করাসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েও ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট পুরোপুরি কাটানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিচ্ছে না। তবে অন্য সবল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দুর্বল ব্যাংককে সহায়তা করতে সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘গত ১৫ বছর ধরে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তবে এখন কেনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ হয়ে না যায়, সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি,’ সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, দুর্বল ব্যাংকগুলো গ্রাহকের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর এই সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধপ্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ‘রাতে গাড়ি নিয়ে বের হতে অনেক মানুষের কষ্ট হচ্ছে, মানে ভয় পাচ্ছে। কারণ কখন কোন দিক দিয়ে আসে, ছুরি আঘাত করে, আহত করে বা নিহত করে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ছিনতাইয়ের শিকার নারায়ণগঞ্জের ইজিবাইক চালক মোহাম্মদ শামীম। ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে। সেখানে প্রকাশ্যে গণছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র মহড়া এবং বিহারি ক্যাম্পে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সেভাবে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। আবার এটাও বাস্তবতা যে, ৫ আগস্টের পর হামলার শিকার পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাগুলোর সবক’টি এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ছাত্র আন্দোলন দমনে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে পুলিশ বাহিনী যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল, সেটিও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামায় নতুন সরকার। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও জনমনে আতঙ্ক রয়েই গেছে। ‘কেমন যেন একটা আতঙ্কে আছি আমরা। আগে রাতে ১২টা-১টায় মানুষ বাইরে বের হতে পেরেছে। এখন তো মানুষ ভয়ের চোটে বের হয় না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা জেসমিন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নারী বলেন, ‘সন্ধ্যার পরে বের হওয়াটা যেন খুব একটা সিরিয়াস ব্যাপার। মনে হয় যে তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুইকা যাই।’ এদিকে গত তিন মাসে গণপিটুনিতে সারা দেশে অন্তত ৬৮ জন মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র। একই সময়ে কমপক্ষে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলেও জানায় সংস্থাটি। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে হামলা ও লুটপাটের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেই প্রশ্ন উঠছে। ‘আমিতো দেখি হোম মিনিস্টার (স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা) অনেক সময় শুনেও না শোনার ভান করেন, (আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে) উত্তর দিতে চান না, এভয়েড করে যান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে গত অক্টোবরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। সরকার বলছে, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেয়া হবে। ‘এটি একটি প্রতিশ্রæতি, যা আমরা দিয়েছি। আমরা প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন দেব,’ বার্তা সংস্থা এএফপিকে সম্প্রতি বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস। কিন্তু সংস্কার শেষ হতে কতদিন লাগবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। ‘সংস্কারের গতিই ঠিক করে দেবে, নির্বাচন কত দ্রুত হবে,’ বলেন অধ্যাপক ইউনূস। যদিও ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগে বলেছিলেন, ‘কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।’

সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলা হলেও বিএনপি চাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোট হোক। ‘নির্বাচন যত দ্রুত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সে জন্যই নির্বাচনের দরকার,’ সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শপথ নেয়ার পর থেকেই অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে কাজটি সম্পন্ন করার কথা বলে আসছে, সেটি হলো- জুলাই-আগস্টের ‘গণহত্যার’ বিচার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আটশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন গুলিতে। হত্যার ঘটনায় ইতোমধ্যেই কয়েকশ মামলা হয়েছে, যেগুলোতে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। ‘গণহত্যার’ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। শেখ হাসিনাসহ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ, তাদের জোটসঙ্গীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেফতারে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে সম্প্রতি অনুরোধও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়। ‘তিনি (শেখ হাসিনা) যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পেন্ডিং আছে। কিন্তু বাংলাদেশের জুরিসডিকশনের বাইরে তিনি চলে গেছেন, সে কারণে ইন্টারপোল

যাতে তাকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা নেয় এবং তার ব্যাপারে অন্তত রেড অ্যালার্ট জারি করে, সেই ব্যাপারে আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি,’ বলছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারে তোড়জোড় দেখা গেলেও বাকি আসামিদের ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন মামলার বাদীরা। ‘আমরা মামলা করেছি আগস্ট মাসে, কিন্তু সেটার অগ্রগতি কী? এখনো তো চার্জশিটই দেয়া হলো না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নিহত ইমাম হাসানের বড় ভাই রবিউল আউয়াল। যারা গুলি চালিয়েছে, পুলিশের সেসব সদস্যের সবাইকে এখনো শনাক্ত করা হয়নি কেন? কেন সবাইকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারকাজ শুরু করা হচ্ছে না,’ ক্ষোভ প্রকাশ করেন আউয়াল। আন্দোলন চলাকালে সারাদেশে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সরকার। তাদের মধ্যে অনেকেই হাত, পা এবং চোখ হারিয়েছেন। আবার পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন অসংখ্য মানুষ। ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন করে নিহতদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি আহতদের ‘সুচিকিৎসা’র ব্যবস্থার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু তিন মাস পর এখন ‘সুচিকিৎসা’র দাবিতে আহতদের বিক্ষোভ করতে দেখা যাচ্ছে। ‘ডাক্তার বলেছে, আমার পেটের মধ্যে গুলি, চিকিৎসা ছাড়া উপায় নাই। আমার পরিবার ধার-দেনা করে এতদিন চিকিৎসা চালিয়েছে। এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। অথচ সরকার ফ্রি চিকিৎসার কথা বলে একবার খোঁজও নেয়নি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন গুলিতে আহত রাইসুল ইসলাম। তবে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তালিকা চূড়ান্তের পরও অর্থছাড়ের প্রক্রিয়ায় কিছুটা দেরি হচ্ছে। ‘সমস্যাটা হলো প্রসেসিংয়ের জায়গাতে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’র সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। এই সরকারকে উৎখাত করতে এখনো তৎপর রয়েছে একটি গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগ সরকারের একটি অংশ যারা চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত। আজকে সেটি করছে বিএনপির লোক। তাই বদনাম তো পিছ ছাড়বে না। এজন্য এই সরকারকে বর্তমানে আওয়ামী লীগকে গায়েল করার পেছনে যে সময় ব্যয় করছে সেটি তাদের অঙ্গীকারভুক্ত কাজের পেছনে দেয়া উচিত বলে জ্ঞানীজন মনে করছেন। সময় এক সময় বদলে যাবে তখন হয়তো নতুন সরকার আসবে। আরো অনেক নতুন হিসাব তৈরি হতে পারে? তাই যারা দেশ চালাচ্ছেন তারা তাদের ওপর মানুষের যে আস্তা এবং বিশ্বাস রয়েছে সেটির সুন্দর বাস্তবায়ন করে যাবেন এই প্রত্যাশা করছেন তাদের অনুসারীরা। নতুন বছরে বিগত দিনের গøানি, অপ্রাপ্তি আর প্রতিশোধপরায়ণ মনের কবর রচনা করা উচিত। সারাদেশে যে উন্নতি হয়েছে তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ করতে হবে, সংখ্যালঘু নামক পীড়াদায়ক শব্দটি এদেশ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হ্রাস করতে হবে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে, অর্থনীতির চাকাকে চলমান রাখতে হবে, তবেই এই সরকার সফলতা লাভ করবে সুশীলরা মনে করেন। বিগত দিনে কী হয়েছিল মানুষ একসময় ভুলে যাবে। কিন্তু এই সরকার সফল না বিফল সে হিসাব করতে দেশের মানুষের কোনো ভুল হবে না। তাই ইউরোপ-আমেরিকার সরকারের মতো দেশের মানুষ সবাইকে আপন ভাবতে হবে, আপন করে নিতে হবে। দেশের অর্জন এবং সম্পদকে কিছুতেই নষ্ট করতে দেয়া হবে না- নতুন বছরে হোক সে অঙ্গীকার। চিন্তা করুন এখন থেকে ডক্টর ইউনূস সরকারকে কিছুতেই হেরে যেতে দেয়া যায় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App