×

পাঠকের কলাম

জাহিদ হোসেন

আবিষ্কার

Icon

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আবিষ্কার
   

কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে সোনিয়ার চিঠি পেয়ে আদনানের ভেতরটা ছটফট করে ওঠে। অনেক কথার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা নামক শব্দটি বারবার তাকে সোনিয়ার কাছে টেনে নিয়ে যায়। সে ক্রমশঃ পেছনের দিকে হাঁটতে থাকে।

সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। সকাল থেকেই আদনানদের কলেজ চত্বরে বসেছিল মেলা। গ্রাম্য ঐতিহ্যের নানা আয়োজনে চারপাশ ছিল মুখর। প্রকাশিত হয়েছিল কলেজের সাহিত্য সংগঠনের পক্ষ থেকে কবিতা পত্র ‘বোশেখের পাতা’। সেখানে ‘আবিষ্কার’ নামে আদনানের একটি কবিতা ছাপা হয়। কষ্টের কথায় মোড়ানো এই কবিতাটির অবয়বে ছিল ভালোবাসার তৃষ্ণা। ছিল ঘৃণার বিদ্রুপ ভুলে যাওয়ার জিয়নকাঠি। পহেলা বৈশাখের সেই আনন্দের দিনে কবিতাটি পড়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন জেগেছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু নানা প্রশ্ন নিয়ে সোনিয়া নামের এক অপরিচিতা উপস্থিত হলো।

রাতে ঘুম হয়নি। আদনান কলেজের পশ্চিম দিকের বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে ঝিরঝির শব্দে বাতাস বইছে। সে বাতাসের সুরে সুরে বৈশাখী আয়োজনের কলরোল ভেসে আসছে। হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠে সে চমকে ওঠে। এক্সকিউজ মি! মুখ ফেরাতেই ঝটপট প্রশ্ন এলো, আপনার লেখা আবিষ্কার কবিতাটি পড়লাম। কষ্টের কথা দিয়ে এখানে ভালোবাসাকে কিন্তু বেশ শাসিয়েছেন। আবার ঘৃণাকে ভুলে যাওয়ার সুনিপুণ যুক্তিও ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতাটি আমার খুব ভালো লেগেছে। কাজিনের কাছে পরিচয় জেনে তাই কথা বলতে এলাম। আপনি কিছু মনে করেননি তো? এক নিঃশ্বাসে মেয়েটি অনেকগুলো কথা বলে গেল।

আদনান বিস্মিত না হয়ে পারল না। যে মেয়েটিকে সে চেনে না, কোনোদিন দেখেছে বলেও মনে পড়ে না, তাকে হঠাৎ কেন যেন ভালো লেগে গেল। অসংখ্য ভাবনার ভিড় ঠেলে সে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনি? মেয়েটি দ্রুত বাধা দিয়ে বলল, আমাকে তুমি বললেই খুশি হবো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আদনান আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি... কথা শেষ না হতেই মেয়েটি উত্তর করল, এখানে খালার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমার নাম সোনিয়া, চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। বলেই সে হাত বাড়িয়ে একটা ডায়েরি আদনানের সামনে মেলে ধরে আবেদনের সুরে বলল, প্লিজ একটা অটোগ্রাফ দিন। মেয়েটি যে অত্যন্ত চঞ্চল, আদনানের বুঝতে কষ্ট হয় না। চঞ্চল মেয়েদের চঞ্চলতা কী কারণে যেন ভালোই লাগে। সে মুচকি হেসে ডায়েরি হাতে নিতে নিতে বলল, আজ পহেলা বৈশাখ। তুমি নিশ্চয় জানো। মেয়েটি ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর করল, জি জানি। আদনান বলল, দেখ তোমার বয়সি মেয়েরা বেশ সেজেছে। পড়েছে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলি, রজনীগন্ধা ফুল। হাতে রিনিঝিনি বাজছে নানা রঙের চুরি। কিন্তু অবাক হচ্ছি তোমাকে দেখে। তুমি মোটেও সাজনি। জানতে পারি, সাজনি কেন?

খানিকটা সংকোচ নিয়ে দুষ্টুমির সুরে সোনিয়া বলল, অনেকেই বলে, সাজলে নাকি আমাকে ভালো লাগে না। সে জন্য সাজিনি। আদনান অবাক হয়ে লক্ষ করল, সোনিয়া আসলেই সুন্দর। তবে সাজলে ভালো লাগবে কিনা বুঝতে পারল না। ডায়রির পাতায় কিছু একটা লিখতে লিখতে সে সোনিয়াকে আবার প্রশ্ন করল, ক’দিন এখানে থাকবে? সোনিয়া উত্তর করল, বেশ কটা দিন। আদনান সময় নিয়ে বলল, আবার কি দেখা হবে? মিষ্টি হেসে সোনিয়া উত্তর দিল, হয়তো হবে। এরপর থেকে প্রায়ই ওদের দেখা হতে থাকে। এর রেশ ধরে একপা, দুপা করে কখন যে ওরা ভালোবাসাবাসির খেলায় জড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।

সময় কারো জন্য বসে থাকে না। সোনিয়ার যাওয়ার সময় হয়ে আসে। যাওয়ার আগে আদনানের সঙ্গে অনেক কথা হয়। কথার ফাঁকে হঠাৎ কী জানি কী ভেবে সোনিয়া বলে ওঠে, আদনান তোমার কবিতা দিয়েই আবারো আমার আবিষ্কার ঘটবে। সেদিন যেন আমাকে চিনতে ভুল করো না। সোনিয়া বিদায় নেয়। আদনান এ কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারে না। মুহূর্তে পৃথিবীর সব কষ্ট যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

আজ যখন সে সব কথা মনে পড়ে তখন তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। পৃথিবীর সব ভালোবাসা শুরু হয় একভাবে, তবে সব ভালোবাসা শেষটা বোধহয় একরকম হয় না। যেমনটি তাদের হয়নি। জীবনটাকে মধুময় করার অভিপ্রায়ে ওরা যখন উদ্বিগ্ন তখন সোনিয়ার হঠাৎ প্রস্থান আদনান মেনে নিতে পারে না। সংবাদ আসে রোড অ্যাক্সিডেন্টে সোনিয়া পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। একটা অদৃশ্য কষ্টে আদনানের সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে কিন্তু কাউকে কিছু জানাতে পারে না। মানুষের অনেক কষ্ট থাকে, সব কষ্টের কথা বলা যায় না। এরপর থেকে আদনান অনেকটাই নিশ্চুপ হয়ে যায়। মনের অজান্তে খানিকটা অনিয়মের মধ্যে বসবাস শুরু হয় তার। অধিক রাত জেগে থাকা, অসময়ে নাওয়া-খাওয়া, কোনো কিছুতেই মনোযোগ আসে না।

ছেলে-মেয়ের কিছু হলে মায়েরা তা আগাম বুঝতে পারে। একমাত্র ছেলের এই দুরবস্থা মা আমেনা রহমানের চোখ এড়ায় না। আদনানের সঙ্গে তার বাবার অনেক মিল খুঁজে পেলেও খানিকটা অমিল লক্ষ করে ভড়কে যায় সে। আদনানের বাবা ছিলেন একজন সৃজনশীল সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। তার লেখা কবিতা-গল্পে উঠে আসত মাটি ও মানুষের চিত্রপট। সে ছিল অত্যন্ত বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ। আদনান বাবার সাহিত্য ভাবনাকে অন্তরে ধারণ করলেও তার মতো হয়নি। সে স্বল্পভাষী এবং ঘরমুখো। আদনানের মা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, আদনানের বাবা একজন রহস্যাবৃত মানুষ। আর এই কারণে তাদের মধ্যে নানারকম সন্দেহের সৃষ্টি এবং বাকবিতণ্ডাও হতো। কারণে অকারণে আমেনা রহমান আদনানের বাবাকে এমন সব প্রশ্ন করে বসতেন, যার উত্তর মাহবুব রহমান খুঁজে পেতেন না। নিখাদ ভালোবাসা আজ আমেনা রহমানকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যার চারপাশে শুধু সন্দেহ, দিধা-দ্ব›দ্ব আর মিথ্যা বিশ্বাস।

মাহবুব রহমান সবকিছু বুঝতে পারলেও স্ত্রীর ওপর আছর হওয়া এই অপছায়াকে দূরে ঠেলে দিতে পারেন না। যার প্রেমের পরশে তিনি লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন, তার এই অবিশ্বাস-সন্দেহ এবং দ্বিধা-দ্ব›েদ্বর মধ্যে বসবাস তাকে ভীষণভাবে কষ্ট দেয়। অনেক কথা থাকে যা বলা যায় না। তিনি কাউকে কিছু বলতে পারেন না। এক ধরনের চাপা আর্তনাদে তার বুকের ভেতরের পুরনো ব্যথাটি ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং একদিন ভোরে হঠাৎ করেই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

আজ আমেনা রহমান বুঝতে পারেন তার ধারণা পুরোপুরি মিথ্যে ছিল। যে মিথ্যে ধারণাকে সম্বল করে তিনি বারবার কষ্ট পেয়েছেন এবং আদনানের বাবাকেও কষ্ট দিয়েছেন; সেই একই ধারণা তিনি ছেলের মধ্যে খুঁজে পেয়ে চমকে ওঠেন। তার সমস্ত অবয়ব দুশ্চিন্তার চাদরে ঢেকে যায়। না-না, তা হবে কেন? তিনি নিজেকে চিন্তামুক্ত করে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে দরজা ঠেলে ছেলের ঘরে ঢোকেন।

আদনান বিছানায় শুয়ে ছিল। মাকে দেখে উঠে বসে বিনীত স্বরে বলল, মা এসো, কিছু বলবে? ছেলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে আমেনা রহমান বললেন, বাবা তোমার কি কিছু হয়েছে? ইদানীং খুব অন্যমনস্ক থাক। বহু কষ্টে আদনান ভেতরের যন্ত্রণাকে আড়াল করে থেমে থেমে বলল, কই নাতো। কিছু হয়নি মা। তুমি অযথা চিন্তা করছো। নরম সুরে আদনানের মা বললেন, তোমার বাবা বেঁচে নেই। তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তুমি যদি ভেঙে পড়ো তাহলে এ সংসারের হাল কে ধরবে? প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিশেষ কিছু সময় আসে। কিন্তু সেটাকে মনের ভেতর লালন করে কষ্ট পাওয়া ঠিক নয়। এটা তো মানতেই হবে সৃষ্টিকর্তা, যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন। মায়ের কথায় আদনান খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে মনে মনে ভাবে, মা কি কিছু জেনে ফেলেছেন। এক ধরনের লজ্জায় তার মুখটি শুকিয়ে ওঠে।

বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমেনা রহমান হতাশ গলায় বললেন, কখন যে ওপারে চলে যাই, ঠিক নেই। শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। আমি তোমার বিয়েটা দেখে যেতে চাই। তুমি চিন্তা করে আমাকে জানিও। ধীর পায়ে আমেনা রহমান পা বাড়ান। আদনান অবাক দৃষ্টিতে মায়ের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে। এর কিছুদিন পর আদনান বিয়ে করে। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সে আস্তে আস্তে সব কিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ভাবেই দিন যায়। একদিন এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে প্রতিবন্ধী সংস্থার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে সে থমকে যায়। মঞ্চ থেকে কেউ একজন তার লেখা সেই ‘আবিষ্কার’ কবিতাটি ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে আবৃত্তি করছে।

‘আমার আবিষ্কার সেতো যন্ত্রণার

কিন্তু বড় বেশি তৃষিত আমি ভালোবাসায়,

কষ্টের গরিমা থেকে ভালোবাসা পেতে

কে না ভালোবাসে।’

সে উৎসুক হয়ে এগিয়ে এসে মঞ্চের পাশে দাঁড়ায়। পা-হীন একটি মেয়ে হুইল চেয়ারে বসে তার লেখা কবিতাটি আবৃত্তি করে চলছে। মেয়েটির চোখে কালো চশমা। সমস্ত অবয়ব, মুখমণ্ডল কাপড়ে ঢাকা। আদনান মেয়েটিকে চিনতে পারে না। তার মনে হাজারও প্রশ্ন জাগে, কে এই মেয়ে? এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে সেদিনের মতো সে বাসায় ফেরে। পরদিন প্রতিবন্ধী সংস্থায় গিয়ে প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে, এই সেই রায়না মির্জা। যার মৃত্যুই হয়েছিল কিন্তু বিধাতা তাকে কি জানি কি অদৃশ্য কারণে বাঁচিয়ে রেখেছে। তবে সে অন্ধ হয়ে গেছে। শরীরের অনেক অংশ অকেজো হয়ে পড়েছে।

আদনানের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়ায়। তার কানে বারবার সোনিয়ার সেই কথাটিই বাজতে থাকে। হয়তো আবারো তোমার কবিতা দিয়েই আমার আবিষ্কার ঘটবে, সেদিন যেন আমাকে চিনতে ভুল করো না। আদনানের চোখের পাতা ভিজে আসে। ইচ্ছে করে সোনিয়ার সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু পারে না। তার মনে হয়, যে যন্ত্রণাকে ভালোবেসে রায়না আজ সুখ খুঁজে নিয়েছে সেখানে তার উপস্থিতি শুধু দুঃখই বাড়াবে। সে প্রতিবন্ধী সংস্থা থেকে ক্লান্ত মনে বের হয়ে বিড়বিড় করে বলে যায়, সোনিয়া তোমার কথাই ঠিক। আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা করে দিও...।

য় টাউন হল চত্বর, রংপুর

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App