সফলতা নেই কাঁচা চামড়ার অর্থনীতিতে

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কুরবানির ঈদ এবং তার সঙ্গে কাঁচা চামড়ার সরবরাহের সম্পর্ক অনেক দিনের। আর এর সঙ্গে অর্থনীতির যোগ বেশ নিবিড়। সংশ্লিষ্ট তথ্যে দেখা যায়, দেশে প্রায় ৩১৫ মিলিয়ন স্কয়ার ফুট ক্রাস্ট ও ফিনিশিড চামড়ার সরবরাহ আছে, তার একটি বিশেষ অংশই আসে কুরবানির সময়।
আর তাই কাঁচা চামড়ার সঠিক সংগ্রহ, সংরক্ষণ- এগুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার আগ্রহ রয়েছে। প্রথমেই বলার ছিল চামড়ার অর্থনীতি কতটা ব্যাপক। ধরে নেয়া যাক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মোতাবেক এ বছর পশুর মজুত ছিল প্রায় ১১ দশমিক ৯ মিলিয়ন। এ মজুতের চেয়ে প্রায় ৭০-৮০ লাখ পশু এ বছর কুরবানি হয়েছে ধরে নেয়া যেতে পারে। প্রতিটি চামড়ার গড় মূল্য যদি ২০০-২৫০ (গরু, ছাগল, মহিষ) টাকা করেও হয়, তাহলে প্রায় ১৫ বিলিয়ন টাকার কেনাবেচা হতে পারে। স্থানীয় ও রপ্তানি বাজার মিলে এবং মূল্য সংযোজিত পণ্য ধরে এর একটি বিপুল অর্থনীতি রয়েছে, তা ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারলে এ থেকে বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি মূল্য আরো পাঁচগুণ বেড়ে ৭৫ বিলিয়ন টাকার মতো হতে পারে, যা অর্জন করা সম্ভব। তারপর এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বিভিন্ন ধরনের প্রান্তিক থেকে বৃহৎ উদ্যোক্তা, মৌসুমি ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক, লবণ ব্যবসায়ী, পশু খামারি, সাধারণ শ্রমিক, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, রপ্তানিকারক, কেমিক্যাল পণ্য প্রস্তুতকারক ও আমদানিকারক, কারখানা শ্রমিক, ম্যানেজার, টেকনিশিয়ান এবং আরো অনেকে। সংশ্লিষ্ট সবার উচিত সুযোগটি যথাযথ কাজে লাগিয়ে এ শিল্পকে সামনের দিকে নিয়ে যাওয়া।
চামড়া শিল্পের প্রতি আমাদের সবার আগ্রহ রয়েছে, কারণ এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। এর কারণে কুরবানি ঈদের পর পরই চামড়া সংগ্রহের খবর বেশ যতœ করে দেখছি, যার প্রচার হচ্ছে ভালো। এত বড় একটা মূল্যবান সম্পদ আমাদের, যার সঠিক ব্যবহারের জন্য কিছুদিন থেকেই শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঘন ঘন সভার আয়োজন করছিল, বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছিল এসব সভা থেকে। এর মধ্যে রয়েছে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ, লবণ যুক্ত করার বিষয়, পরিবহন, সংরক্ষণ, মজুত, পাচার না হওয়া, বাইরে থেকে পশু না আসা। কারণ দেশেই যথেষ্ট মজুত রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি, যাতে কোনোভাবেই এ সম্পদ নষ্ট না হয়।
এ কথা সত্যি, গত কয়েক বছরে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা তেমন ভালো নয়। সঠিক মূল্য পাননি বলে অনেকে কাঁচা চামড়া ফেলে দিয়েছেন, মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন এ ধরনের খবর পাওয়া গিয়েছিল। এবার যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সব মহল যথেষ্ট তৎপর ছিল। তবে কাঁচা চামড়ার দরপতন লেগেই আছে। তবে এখনো সংশয় যেটা রয়েছে, তা হলো মূল্য নিয়ে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থাকেন এ থেকে যাতে কিছু আর্থিক সুবিধা তারা পান। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে জানা যায়, এ বছর ঢাকায় ২৫ লাখ ২০ হাজার, চট্টগ্রামে ১৯ লাখ ৭৪ হাজার আর রাজশাহীতে ২৩ লাখ পশু বিক্রি হয়েছে। গত বছর কুরবানির ঈদে ৯৪ লাখ ৪৩ হাজারের অধিক পশু বিক্রি হয়। তথ্য মতে গত বছর কুরবানিযোগ্য পশু ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩৩টি। এর মধ্যে ১ কোটি ৪১ হাজার ৫১২টি পশু কুরবানি হয়েছে। অর্থাৎ ২৫ লাখের অধিক অবিক্রীত ছিল। আর ২০২২ সালে সারাদেশে ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি পশু কুরবানি হয়েছিল। এত অধিক পশু অবিক্রীত থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হন খামারি ও বেপারিরা। খামারিদের মধ্যে যারা বড় গরু বাজার এনেছিলেন অধিকাংশ পশু অবিক্রীত থেকে যায়। ফলে বিপাকে পড়েছেন তারা। চড়া দামের খাবার খাইয়ে, ব্যাংক ঋণ নিয়ে যারা খামার করেছেন, তাদের অবস্থা করুন। ভারত, মিয়ানমার থেকে এবার অবৈধ পথে পশু আসায় এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ বছর ছোট ও মাঝারি গরুর চাহিদা ছিল বেশি। সেই তুলনায় বড় গরুর ক্রেতা ছিল কম। এটা ঠিক যে, কাঁচা চামড়ার মূল্য অতীতে অনেক বেশি ছিল। যেমন ২০১৩ সালে গরুর চামড়া প্রতি স্কয়ার ফুট ছিল ৮৫-৯৫ টাকা এবং ছাগলের চামড়ার মূল্য ছিল ৫০-৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে এর দাম ছিল ৭৫-৮০ টাকা। ২০১৭ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ৫০-৫৫ টাকা এবং ২০-২২ টাকা আর ঢাকার বাইরে ছিল ৪০-৪৫ টাকা। এ খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, আগে চামড়া মানেই লবণযুক্ত চামড়াকেই বোঝানো হতো। ২০১৮-১৯ সময়ে বিষয়টি পরিবর্তন হয়, অর্থাৎ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা লবণ ছাড়াই দ্রুত মুনাফার জন্য এবং লবণের দামের সাশ্রয়ের জন্য বড় মহাজনের কাছে কাঁচা চামড়া পৌঁছে দিতে চান কিছু নগদ লাভের জন্য, যা ক্ষেত্রবিশেষে লবণযুক্ত বা মুক্তও হতে পারে। পশুর চামড়ার ব্যাপারে গুণগত মান সংরক্ষণ একটি বিশেষ ব্যাপার। এদিকে লক্ষ রেখে যত দ্রুত লবণ দেয়া যায় ততই মঙ্গল। অর্থাৎ কুরবানির ৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি লবণ দেয়া যায় সেটাই ভালো। কোরবানির ঈদের আগে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সভায় কিন্তু এটি আলোচনায় এসেছিল এবং এটাও বলা হয়েছিল যে লবণের কোনো ঘাটতি নেই, তাই আমদানির দরকার নেই। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন লবণের দাম বেড়ে গেছে, তাই কিছুটা প্রক্রিয়াকৃত চামড়ার দাম বেশি পড়ে যাচ্ছে। ৭৫ কেজি একটি লবণের বস্তায় ২০০-৩০০ টাকা বেড়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ৯০০ টাকায় পৌঁছেছে, যা এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জন্য মোটেও সুখবর নয়। অথচ লবণের দাম ৮-১০ টাকার বেশি হওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়। সেই মতে, একটি বড় গরুর জন্য ১০-১২ কেজি লবণ দরকার হয়, যার দাম ১২০ টাকা, যিনি লাগাবেন তার মজুরি ৩০ টাকা ধরে মোট ১৫০-১৮০ টাকা। সে হিসাবে একটি মোটামুটি মাঝারি থেকে বড় গরুর চামড়া লবণ যুক্ত করার মূল্য প্রাথমিকভাবে ২০০-২৫০ টাকা হতে পারে। বড় আকারের গরুর মোট চামড়ার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ স্কয়ার ফুট হতে পারে। তবে বাংলাদেশে বেশির ভাগ গরুই ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ স্কয়ার ফুটের মধ্য দেখা যায়। চামড়ার অনেকটা অংশ ব্যবহারযোগ্য করা যায় না, তাহলে একটি গরুর চামড়ার মূল্য অন্ততপক্ষে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা হওয়া দরকার এবং ছাগলের ক্ষেত্রে এটা অন্তত ৪০০-৬০০ টাকা হতে পারে। কিন্তু ফড়িয়াদের মুখে যা জানা গেল, তাদের ৭০০-৮০০ টাকা খরচ পড়ছে; কিন্তু সে তুলনায় তারা দাম পাচ্ছেন না।
এরপর রয়েছে চামড়া পরিষ্কার করার ব্যাপারটি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে বারবার সাবধানতার কথা বলা হলেও এবং ব্যাপক প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকলেও দেখা যায়, এক্ষেত্রে চর্বি বা কিছু মাংস থেকে যাওয়ার ফলে চামড়ায় দ্রুত পচন ধরে যায় এবং গুণগত মান নষ্ট হয়। বাংলাদেশে মেকানাইজড সেøাটার হাউস নেই বললেই চলে, যা চামড়ার মান সংরক্ষণে বিশেষ জরুরি। এছাড়া পশুর চামড়া আলাদা করার মেশিনও রয়েছে, যা চামড়ার গুণগত মান সংরক্ষণে সহায়ক হতে পারে। ২০১৯ সালে কুরবানির পশুর চামড়ার দামে ধস নামে। ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের অনেক জায়গায় মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সড়কে ফেলে দেন। মাটির নিচেও পুঁতে ফেলেছেন। এ বছর গরুর কাঁচা চামড়া ৫০০-৯০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ছোট গরুর চামড়া ২০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামে চামড়া ক্রয়-বিক্রয় না হওয়ার পারস্পরিক অভিযোগ শোনা যায়। তার ওপর রয়েছে সাভার ট্যানারির অবকাঠামোগত সমস্যা, সিইটিপির সঠিকভাবে ফাংশন না করা, কুরবানির পর অতিরিক্ত চামড়া প্রক্রিয়াকরণের ভার এ অবকাঠামো বইতে পারছে না। সলিড ওয়েস্ট ব্যবস্থাপনা সমস্যা, ডাম্পিং ইয়ার্ড, ক্রম রিকভারি ইউনিট, প্রি-ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের সচেতনতা ইত্যাদি এরই মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। যে ডাম্পিং ইয়ার্ড রয়েছে, তা দিয়ে হয়তো ৫০ টন বর্জ্য রাখা যাবে, এ রকম দুটি বা তিনটি রয়েছে; কিন্তু কুরবানির পর যে বিপুল পরিমাণ চামড়া পরিশোধন হবে, তার বর্জ্য কীভাবে ম্যানেজ হবে। এসব বিষয়ের একটি চেইন ইমপ্যাক্ট রয়েছে পুরো খাত ঘিরে। তাই পুরো বিষয়টিকে আলাদাভাবে না দেখে সব বিষয়কে সমন্বিতভাবে দেখা দরকার।
চামড়া শিল্প নিয়ে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকলেও সমন্বয়হীনতার অভাবে সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। চলতি বছরে কুরবানির ঈদের পশুর চামড়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে জাতীয়ভাবে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
মাহমুুদুল হক আনসারী : লেখক ও সংগঠক, চট্টগ্রাম।