মির্জা ফখরুল
ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক আরোপ অপরিণামদর্শী

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ প্রতিবেদক : একশর বেশি পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ সরকারের ‘অপরিণামদর্শী’ সিদ্ধান্ত অভিহিত করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল শনিবার সকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপে সাধারণ মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা তুলে ধরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই দাবি জানান।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চলমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তথা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই একশর বেশি পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে এবং কিছু পণ্যের কর অব্যাহতি তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পোষাক, ওষুধ এবং ইন্টারনেটসেবা। সরকারের এই সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠির ওপর নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে, চাপ বাড়াবে। বিএনপি বর্তমান সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণের জীবনের ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা সাধারণ জনগণের ওপর কর এবং ভ্যাট তথা পরোক্ষ কর আরোপের মতো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানাচ্ছি।
বর্তমান সরকারের এই নতুন করারোপের ফলে কী কী প্রভাব পড়বে তা তুলে ধরে মির্জা ফখরুল বলেন, এর ফলে বর্তমানে প্রায় ১৩ শতাংশ ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে, পরিবারের সঞ্চয় কমবে এবং ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হারও বাড়বে। বর্তমানে নিম্নমুখী ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আছে, তা আরো কমবে। কর্মসংস্থান আরো কমে যাবে, বৃদ্ধি পাবে বেকারত্বের সংখ্যা। উচ্চমূল্যে জ্বালানি খরচ আরো বাড়বে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর কমপ্লায়েন্স প্রেসার বাড়বে। ব্যবসায়িক ব্যয় এবং শিল্প কারখানাগুলোতে উৎপাদন খরচ বাড়বে, ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা আরো কমবে, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠবে। ব্যবসায়ে বিনিয়োগ কমবে, রপ্তানি প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমবে। সর্বোপরি অর্থনীতি ও দেশের জনগণের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র বিবেচনায় এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় যে, নতুন করে ভ্যাট আরোপে স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্দশা চরমভাবে বৃদ্ধি আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের এমন আকস্মিক সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ী মহলসহ আর্থিক খাতে সংশ্লিষ্ট নানা মহলের তীব্র অসন্তোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের চরম ঘাটতি রয়েছে।
সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা আগেও বলেছি সরকারকে আমরা সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাব। তাই সরকারকে অনুরোধ করছি, আপনারা নীতিমালা প্রণয়নে জনগণের কথা সর্বপ্রথম বিবেচনায় নিন। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় রাজস্ব সংগ্রহের জন্য অন্যান্য উপায় বিবেচনা করার এবং সেই অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ রয়েছে। পরোক্ষ কর না বাড়িয়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিন।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের সর্বপ্রথম নজর দেয়া উচিত খরচ কমানোর দিকে। আমরা মনে করি, সরকার তার উন্নয়ন বাজেট পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় ও আর্থিকভাবে অযৌক্তিক প্রকল্পগুলো বাদ দিলে প্রায় ২০ শতাংশ খরচ কমানো সম্ভব এবং এতে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে সহায়ক হবে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে মানুষের আয় বেড়েছে ৮ শতাংশ, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ১৪ আগস্ট আশ্বাস দিয়েছিলেন ৫-৬ মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। কিন্তু বাস্তবে তা বরং বেড়েছে। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, অপ্রয়োজনীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত মেগা প্রজেক্টের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ আপাতত বন্ধ রেখে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব। পতিত সরকার কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বর্তমান বাজেটে বরাদ্দ রেখেছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার পরিমাণ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নিজেদের স্বার্থে বছরের পর বছর বাড়ানো হয়েছে এগুলোর মেয়াদ। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে চলেছে হরিলুট। গত ১৪ বছরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে এমন লুটপাট হয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপর। শ্বেতপত্র কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে যে, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশই লুটপাট করা হয়েছে। এছাড়া বাজেটের এমন অনেক খাত রয়েছে, যেমন অবকাঠামো খাতগুলোতে বরাদ্দকৃত বাজেটের অধিকাংশ অর্থই ব্যয় করা সম্ভব হয় না। এসব খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ কমিয়ে বাজেটের আকার আরো যৌক্তিকভাবে ছোট করে আনা সম্ভব। এভাবে খরচ কমানোর পাশাপাশি সরকার এমন কিছু উৎস ও উপায় খুঁজে বের করতে পারে যা জনগণের, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ ফেলবে না।