অবশেষে যুদ্ধবিরতি আজ থেকে

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কাগজ ডেস্ক : ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের মধ্যে হওয়া গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি আজ রবিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে কার্যকর হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে গাজায় দীর্ঘ ১৫ মাস ধরা চলা রক্তক্ষয়ের অবসান হওয়ার পথ খুলছে। এদিকে, ফিলিস্তিনের সরকারি জোট ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) জানিয়েছে, গাজা উপত্যকার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ফিরিয়ে আনা, পানি ও বিদ্যুৎসহ জরুরি সব পরিষেবা ফের চালু করা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং উপত্যকার ভবন, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের কাজে নেতৃত্ব দেবে পিএ।
সোয়া এক বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনে যে কয়েকটি দেশ মধ্যস্থতা করেছে, কাতার তাদের অন্যতম। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি গতকাল শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বলেন, পক্ষগুলোর মধ্যে হওয়া চুক্তি মোতাবেক রবিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় (বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টায়) গাজা ভূখণ্ডে যুদ্ধবিরতি শুরু হবে। আমরা আমাদের ভাইদের সাবধান থাকতে, সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রদর্শন ও সরকারি সূত্রগুলো থেকে নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিচ্ছি।
ইসরায়েলের জোট সরকারের মন্ত্রিসভা শুক্রবার ৬ ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠক শেষে গভীর রাতে চুক্তিটি অনুমোদন করে। এর আগে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করে। চুক্তি অনুযায়ী, ছয় সপ্তাহের প্রথম ধাপেই হামাস ৩৩ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে, তার বিনিময়ে ইসরায়েলও তাদের জেলে আটক ৭৩৭ ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেবে। এই সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনীতে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাও ছাড়তে হবে, আর বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা পাবে বাড়ি ফেরার অনুমতি। প্রতিদিন শত শত ত্রাণবাহী লরিকে গাজায় ঢোকারও সুযোগ দেবে তেল আবিব।
চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে প্রথম ধাপের ১৬তম দিনে। এই ধাপেই মুক্তি পাবে পুরুষ ইসরায়েলি সেনারা। তৃতীয় ও শেষ ধাপে হবে গাজার পুনর্গঠন, যা শেষ হতে লাগবে কয়েক বছর। তবে হামাস জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি স্থায়ী না হলে এবং ইসরায়েলি বাহিনী গাজা না ছাড়লে তারা প্রথম ধাপের পর আর কোনো জিম্মিকে ছাড়বে না।
কাতার জানিয়েছে, প্রথম ধাপে যে জিম্মিরা মুক্তি পাচ্ছেন তাদের মধ্যে বেসামরিক নারী, শিশু, নারী সেনা, বয়স্ক ব্যক্তি, অসুস্থ ও আঘাতপ্রাপ্ত বেসামরিকরা রয়েছেন। এদিকে ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা যুদ্ধবিরতির প্রথম দিন আজই ৩ জিম্মির মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী, পরবর্তী ছয় সপ্তাহে নিয়মিত বিরতিতে এরকম ছোট ছোট দলে বাকিরাও মুক্তি পাবে।
ইসরায়েল বলছে, হামাসের হাতে এখনো ৯৪ জন জিম্মি আছে। এর মধ্যে ৩৪ জন মারা
গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর বাইরে যুদ্ধের আগে ৪ জন ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে দুজন মৃত।
৭৩৭ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল : গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নের প্রথম পর্যায়ে মুক্তি দেয়ার জন্য ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি ৭৩৭ ফিলিস্তিনির হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করেছে ইসরায়েলি বিচার মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় আজ বিকাল ৪টার আগে এই বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে না।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় মুক্তি দেয়ার জন্য এর আগে কারাবন্দি ৯৫ ফিলিস্তিনির একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয়। পরে এই তালিকা হালনাগাদ করা হয়।
ইসরায়েলি তালিকায় কারাবন্দি খালিদা জাররারের নাম আছে। তিনি ফিলিস্তিনি সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের নেতা। একইসঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনের আইন পরিষদের সদস্য। তালিকায় ফিলিস্তিনের সাংবাদিক বুশরা আল-তাবিলের নামও রয়েছে।
ফিলিস্তিনি ৩ সংগঠন- হামাস, ইসলামিক জিহাদ ও ফাতাহর বেশ কয়েকজন সদস্যকে মুক্তি দিতে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে ইসরায়েল। তাদের অনেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করে আসছেন।
গাজার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ : গাজা উপত্যকার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনের সরকারি জোট ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ)। শুক্রবার ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট এবং পিএ জোটের বৃহত্তম শরিক ফাতাহর শীর্ষ নেতা মাহমুদ আব্বাসের দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট আব্বাসের নির্দেশনা অনুযায়ী গাজা উপত্যকার পূর্ণ দায়দায়িত্ব নিতে যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করেছে ফিলিস্তিনের সরকার। এই দায়িত্ব পালনের জন্য যেসব প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা টিম প্রয়োজন, সেসব গঠনের কাজও শেষ হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ফিরিয়ে আনা, পানি ও বিদ্যুৎসহ জরুরি সব পরিষেবা ফের চালু করা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং উপত্যকার ভবন, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের কাজে নেতৃত্ব দেবে পিএ।
গাজা উপত্যকায় এক সময় ফাতাহ ক্ষমতাসীন ছিল। ২০০৬ সালের নির্বাচনে সেখানে হামাস জয়ী হয়। তারপর ২০০৭ সাল শেষ হওয়ার আগেই ফাতাহকে উপত্যকা থেকে বিদায় করে হামাস। বস্তুত ২০০৬ সালের পর আর কোনো নির্বাচন হয়নি গাজায়। ফলে, গত প্রায় ১৯ বছর ধরে উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করছে হামাস।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে যে অতর্কিত হামলা ঘটেছিল, তার মূল পরিকল্পনাকারী এবং নেতৃত্বের ভূমিকায়ও ছিল হামাস। নজিরবিহীন সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ জন। পাশাপাশি প্রায় আড়াইশ জনকে জিম্মি হিসেবে গাজায় ধরে নিয়ে যায় হামাস ও ইসলামিক জিহাদের যোদ্ধারা।
হামলার জবাব দিতে এবং আটক জিম্মিদের উদ্ধার করতে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী- যা পুরোপুরি শেষ হচ্ছে আজ। ১৫ মাসের ভয়াবহ এই অভিযানে গাজায় নিহত হয়েছেন ৪৬ হাজার ৮৭০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি। আহতের সংখ্যা ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি। আরো প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনীর টানা বোমা বর্ষণে গাজার ৬০ শতাংশেরও বেশি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। বিদ্যুৎসহ অন্যান্য জরুরি পরিষেবা কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং ধ্বংসস্তূপের যে পরিমাণ জঞ্জাল সেখানে জমেছে, তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে ১২ থেকে ১৫ বছর লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
##