×

সম্পাদকীয় ও মুক্তচিন্তা

দড়ি ধরে মারল টান রাজা হলো খান খান

Icon

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দড়ি ধরে মারল টান রাজা হলো খান খান

রাজনীতি অনেকটাই দাবার চালের মতো। এক চালেই বাজিমাত হয়ে যেতে পারে, আবার এক চালেই পুরো খেলার রাজা মারা যেতে পারে। রাজনীতির এ দাবার চাল বাংলাদেশে এবার দুটিকেই এক করে দিল। সঠিক এক চালে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছাত্রসমাজ, আর ওই এক ভুল চালেই ক্ষমতার মৃত্যু শেখ হাসিনার। এমন ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই নয়, বারবার ঘটেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও। মদের ফোয়ারা, বিলাসের স্বর্গ, অর্থের বন্যা বইয়ে দেয়া এক পার্টিতেই বদলে গিয়েছিল ইরানের ভাগ্য একসময়। এক জমকালো ফুর্তির পার্টি বদলে দিয়েছিল সে দেশের ভাগ্য। ১৯৭১ সালের পূর্বে শাহের ইরান ছিল আজকের ইরানের তুলনায় ১৮০ ডিগ্রি ভিন্ন। পশ্চিমা সংস্কৃতির রীতিমতো পীঠস্থান ছিল সে দিনের ইরান। আর আজকের ইরান পশ্চিম এশিয়ার অন্যতম গোঁড়া মুসলিম দেশ। ১৯৭১ সালে একটি জমকালো রাজকীয় পার্টি দিয়েছিলেন সে সময়ের ইরানের রাজা শাহ মহম্মদ রেজা পাহলভি। রাজার হঠাৎ খেয়াল হলো দেশ-বিদেশের রাজ-রাজরা, আমির-ওমরাদের আমন্ত্রণ করে মনোরঞ্জন করাবেন। ইরানে তখন পারস্য রাজতন্ত্রের ২,৫০০ বছর পূর্তি। সেই বর্ষপূর্তিতেই আয়োজন করা হয় এই ফুর্তির। পার্টির প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল এক বছর আগে থেকেই। ১১০ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত রাজার রাজপ্রাসাদও এই পার্টির জন্য পছন্দ হলো না। রাজার পার্টির ব্যবস্থা হলো মরুভূমিতে। মরুভূমির বুকে ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যজুড়ে গড়ে তোলা হলো এক কৃত্রিম শহর। অতিথিদের থাকার জায়গা থেকে শুরু করে পানভোজনের এবং মনোরঞ্জনের জায়গা- সবই এক বছর ধরে তৈরি করা হলো এ কৃত্রিম শহরে। ৬৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন আমন্ত্রিতদের তালিকায়। মরুভূমির বুকে যখন রাজার এ কর্মকাণ্ড চলছে, ইরানের সাধারণ মানুষের দিন কাটছিল তখন অতি কষ্টে। দিনে তিন বেলা খাওয়া হতো না অনেকেরই। কিন্তু রাজার মাথায় তখন একটাই চিন্তা- বিদেশি অতিথিদের জন্য তিনি কীভাবে মুগ্ধতা আনবেন! তিন দিনের এ রাজকীয় অনুষ্ঠানে তাই আনা হলো ২৫ হাজার ওয়াইনের বোতল। তৈরি হলো ১৮ টন খাবার। অতিথিদের সেবা প্রদানে নিয়োগ দেয়া হলো ১৮০ জন ওয়েটার। ইরানের কিছু মানুষ যখন খাবারের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে, তখন রাজকোষ থেকে ব্যয় হয়ে গেল ১০ কোটি মার্কিন ডলার। রাজা রেজা পাহলভিকে নিয়ে এমনিতেই ইরানের গোঁড়া মুসলমানদের মনে ক্ষোভ ছিল। এ রাজকীয় পার্টি সে রাগ বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। সে সময়ে রাজার কট্টর সমালোচক শিয়া ধর্মগুরু হঠাৎই জনসমর্থন পেতে শুরু করেন। সেই ধর্মগুরু আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনির নেতৃত্বে জনতার রোষ একটা সময় এতটাই বেড়ে যায় যে, প্রাসাদ ছেড়ে পালাতে হয় রাজা-রানীকে। ইরানে এরপরই খোমেনির নেতৃত্বে তৈরি হয় নতুন ইসলামিক সরকার। প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসলামিক আইন। বদলে যায় ইরানের ভাগ্য।

ফরাসি বিপ্লব? তা-ও তো ইতিহাসের শিক্ষার আর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। বিপ্লবের অল্প কয়েক দিন আগেও পুরো দেশের মানুষ এমন একটা বিপ্লবের কল্পনাও করতে পারেনি। দেশে ছিল না কোনো বিরোধ-বিপত্তি- সবকিছু ছিল সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু রাজপ্রাসাদের খরচ এবং সম্রাজ্ঞীর সীমাহীন বিলাসিতা পূরণ করার ক্ষমতা রাজকোষের ছিল না। ফ্রান্সে চলছে তখন সীমাহীন অর্থনৈতিক সংকট। ঠিক সে সময় হঠাৎ করেই সম্রাটের সরকার রুটির দাম বাড়িয়ে দেয়। বিক্ষোভ করার মতো সাহসী পুরুষ তখন পুরো ফ্রান্সে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে রুটি তৈরির বেলুন ও ব্যালন হাতে ফ্রান্সের নারীরা রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। রাজার পুলিশ-সেনাবাহিনী তাদের দিকে উপহাসের হাসি হাসে- ঠাট্টা-মশকরা করে। কিন্তু এভাবে বেশি দিন যায় না। হঠাৎই রাজার বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যায়। এমন বিপ্লবের আরো কিছু নমুনা ইতোমধ্যে বিশ্ববাসী দেখেছে। বাংলাদেশের আগস্ট বিপ্লব অতীতের সব ইতিহাসকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান, বেলারুশে স্বৈরাচারী লুকাশেঙ্কোর বিরুদ্ধাচারীদের ঠেকাতে সেনা অভিযান কিংবা পাকিস্তানে শাহবাজ শরিফ সরকারের বিরুদ্ধে পিটিআইয়ের বিক্ষোভ- কোনো আন্দোলনেই নিহতের সংখ্যা দুই ডজনের বেশি ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম ২০১১ সালে মিসরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান। সেই আন্দোলনে প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ৮৫০ জনের। জাতিসংঘের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের এই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাণ গিয়েছে ৬৫০ জনের। বাংলাদেশে যা ঘটে গিয়েছে, তাকে বর্বর হত্যাকাণ্ড বলা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ বর্বরতার শুরু আবু সাঈদকে হত্যার মাধ্যমে।

ইতোমধ্যে দেশবাসী বুঝতে পেরেছে, পরাক্রমশালী শেখ হাসিনাকে কেন এভাবে সব ছেড়েছুড়ে দেশ থেকে পালাতে হলো। কী কী ভুল তিনি করেছেন তা যদি ক্রমানুসারে বলতে যাই, তাহলে বেশ লম্বা হবে সে তালিকা। তবে প্রথমেই আসবে তার চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য। দেশের মানুষকে, ছাত্রসমাজকে সঠিক মূল্যায়ন না করার ঔদ্ধত্য। দ্বিতীয় কারণ নির্বাচন। নির্বাচনকে তিনি প্রহসনে পরিণত করে গণতন্ত্রের শেষ পেরেকটি গেঁথে ফেলেছিলেন। গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানকে অন্ধ, আনুগত্য, আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করেছিলেন। তৃতীয় জায়গাটি ছিল বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগকে তিনি নিজের এবং দলের সুবিধামতো চালনা করেছিলেন। চতুর্থ জায়গাটি ছিল আইনের শাসনের অবলুপ্তি। বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুমকে করে ফেলা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অতি সাধারণ অংশ হিসেবে। পঞ্চম জায়গাটি ছিল দুর্নীতি। ৫০০ টাকার বালিশ কেনা হয় ৫ হাজার টাকায়। সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ পদের ব্যক্তি থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নপদ পর্যন্ত ঘুষ ও দুর্নীতির খোলামেলা বিচরণ ঘটেছিল তার শাসনামলে। দেশের অবকাঠামোগত বেশ কিছু উন্নয়ন হলেও তাকে মøান করে দিয়েছিল বিপুল পরিমাণ ঘুষ ও দুর্নীতির দানবটি। ষষ্ঠ জায়গাটি ছিল দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি রোধে চরম ব্যর্থতা। সপ্তম জায়গাটি ছিল রাজনীতি ও সমাজে বিভাজন তৈরি করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ এবং বিপক্ষের ধুয়া তুলে সমাজজীবনে অযথাই বিভাজন তৈরি করেছিলেন তিনি। এতসব ব্যর্থতা থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার দল জনগণের কাছে তাদের অবস্থানটা সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি কখনো। কাক যেমন নিজে চোখ বুজে ভাবে, সবার চোখই বন্ধ আছে- তারাও সবাইকে বোকা ভেবে তৃপ্তির ঢোক গিলতে থেকেছে। অন্ধ হলেই বিপদ বন্ধ হবে- তাদের এমন ভাবনা বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়েছে এবার। সহ্যের সীমা না পেরোলে বিপ্লব হয় না। শেখ হাসিনার ওপর সাধারণ ছাত্র-জনতা কতটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল, এ বিপ্লব তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ।

আগস্ট মাসটি যেন মাঝে মধ্যেই বাংলার মাটিকে কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট পাকিস্তান এবং ভারতের জন্মলগ্নে বাংলা ভেসে গিয়েছিল হাহাকারে। তারও আগে ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে নোয়াখালীসহ অন্যান্য অঞ্চল দেখেছিল হিংস্রতার তাণ্ডব। ২৪ বছরের শাসন-শৃঙ্খল কাটিয়ে ১৯৭১ সালে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। নবজাত দেশের হাল ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল সেই বঙ্গবন্ধুকেই। ৫০ বছর পার হয়ে ২০২৪ সালের জুলাই পার হয়ে সেই আগস্ট মাসেই বাংলার মাটি আবার দেখল অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় ছাত্র-জনতার এক গণ-অভ্যুত্থান। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধিতার হাত ধরে ছাত্র আন্দোলন; তার উত্তরে নিষ্ঠুরতম রাষ্ট্রীয় হিংসা এবং তার প্রতিবাদে দেশ ভাসানো অভ্যুত্থান। যে আওয়ামী লীগের নাম এতদিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল, সেই দলের বিরুদ্ধেই রচিত হয়ে গেল আরেকটি ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’। ৫ আগস্ট জনতার রোষাগ্নি প্রতিহত করতে না পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আক্ষরিক অর্থেই পালিয়ে গেলেন। ফলে গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা থেকে ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বলে শেখ হাসিনার রাজার শাসন খান খান হয়ে গেল।

এবারের আন্দোলন একটি ঐতিহাসিক সত্য নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছে। রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্ম দেয় না- নাগরিকরাই রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। রাষ্ট্র নাগরিক বাছাই করতে পারে না- নাগরিক বরং তার রাষ্ট্র বাছাই করে। অতীতের শিক্ষা নিয়ে আজকের এই আগস্টের বাস্তবতায় ভাবতে বসে আবার কিছুটা শঙ্কায়ও ভুগছি। সাতচল্লিশের আগস্ট হিন্দু-মুসলমান অবিশ্বাস, সন্দেহ ও ঘৃণা দূর করতে পারেনি। পঁচাত্তরের আগস্ট ভাষা-সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে উপহার দিয়েছিল ধর্ম-রাজনীতির বিষাক্ত ছোবল। ২০২৪ সালের আগস্টের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে তো বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক আর অসাম্প্রদায়িক এক নতুন বাংলাদেশ? হবে তো আরোপিত অপরিণত সত্তা থেকে মুক্তি লাভ করে আলোকপ্রাপ্তি? পাব তো স্বাধীনতা- যুক্তি-বুদ্ধি ব্যবহারের স্বাধীনতা? শাসকের গাত্রবর্ণের বদল নয়- শাসকের ভাবনার শাসন থেকে মুক্তির স্বাধীনতা?

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আড়াইশ’র আগেই থামল বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস

আড়াইশ’র আগেই থামল বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস

পাঁচদিন টানা বৃষ্টির আভাস

পাঁচদিন টানা বৃষ্টির আভাস

সংসার ভাঙল কণ্ঠশিল্পী কনার

সংসার ভাঙল কণ্ঠশিল্পী কনার

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু

এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App