বিচারপতি তোমার বিচার

মযহারুল ইসলাম বাবলা
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা। সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুরের গানটি আমাদের লড়াই-সংগ্রামে, আন্দোলনে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। গণসংগীতটি আমাদের বেতার-টিভিসহ সব মাধ্যমে সম্প্রচার হয়ে আসছে। গানটি নিয়ে এ পর্যন্ত আদালত অবমাননার কোনো মামলা হয়নি। হয়নি গানটি নিষিদ্ধও। আমাদের বিচার বিভাগ বা বিচারপতিদের প্রসঙ্গে লিখতে বসে এক ধরনের আতঙ্ক সবাই অনুভব করে থাকেন। বিচারক বা আদালতের রায় নিয়ে মন্তব্য করাও নাকি আইনি অপরাধতুল্য। ঔপনিবেশিক আমলের আইনি সেই ধারাটি এখনো সক্রিয়। দেশের প্রধান নির্বাহী থেকে সব ব্যক্তি ও স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনার বৈধতা থাকলেও বিচারক-বিচারব্যবস্থার কোনোরূপ সমালোচনা-মন্তব্য করার বিধান নেই। গণতান্ত্রিক দেশে ঔপনিবেশিক রাজতান্ত্রিক কালো আইন থাকা নিশ্চয় বাঞ্ছনীয় নয়। রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না। সে যে পদেই আসীন হোন না কেন। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সম-অধিকার সাংবিধানিক। সব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এবং পেশাজীবীও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে হতে পারেন না।
আমাদের বিচার বিভাগ নিয়ে নানা রস-কৌতুক রয়েছে। যেমন এক ব্যক্তি কারো কাছে অহেতুক ৫০০ টাকা পায় বলে দাবি করলে এবং টাকা না দিলে মামলার হুমকি প্রদানে, প্রবাদতুল্য উপদেশ হচ্ছে, মামলা এড়াতে ৫০০ টাকা প্রদান করাই উত্তম। কেননা আদালতে শরণাপন্ন হওয়া মানেই একটি মুরগির জন্য একটি গরু হারানোর শামিল। আমাদের বিচারব্যবস্থার নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি তো রয়েছেই। সুবিচারের আশায় আদালত পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কত মানুষ নিঃস্ব যেমন হয়েছে, আবার কতিপয় হয়েছে বিত্তশালীও। দোষী অপরাধী আইনের ফাঁক গলিয়ে জাঁদরেল আইনজীবীর সহায়তায় যেমন বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। তেমনি নিরপরাধী অর্থ এবং জাঁদরেল আইনজীবীর অভাবে শাস্তি পেয়ে থাকেন। আমাদের আইনজীবীদের ক্ষেত্রে যত বড় অপরাধীকে আইনি মারপ্যাঁচে বেকসুর খালাস করিয়ে দিতে পারেন, তিনি ততোধিক বিজ্ঞ-জাঁদরেল আইনজীবী। অপরাধীকে উকিল-ব্যারিস্টার সাহেবদের আইনি মারপ্যাঁচে নিরপরাধ প্রমাণের ওপর নির্ভর করে আইনজীবীদের সাফল্য-যশ-মান-মর্যাদা এবং অর্থপ্রাপ্তিও। আমাদের সাহিত্যেও এমন প্রচুর কেচ্ছা-কাহিনি রয়েছে।
আমাদের বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কী? বিচার বিভাগ বিচারকদের নিয়ে নানা রম্য কাহিনি লোকমুখে শোনা যায়। কর্নেল তাহেরের বিচার প্রহসনে কৌশলী হওয়ার বদৌলতে আইনজীবী এ টি এম আফজাল উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এমনকি তাকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিল জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার। সেই পরম্পরা থেমে নেই। অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে প্রধান বিচারপতির চাকরির সময়সীমা ৫৭-৬০ বছর বৃদ্ধির আবেদন সরকার নাকচ করেছিল। অথচ বিচারপতি কে এম হাসান আবেদন না করলেও তার ক্ষেত্রে আচানক সরকার ৩ বছর সময়সীমা বৃদ্ধি করেছিল। জোট সরকার পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের অভিপ্রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান রূপে প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের মেয়াদ বৃদ্ধির যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সেটা পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী জোটগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান রূপে প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে মেনে নেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে প্রধান বিচারপতিকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করেছিল।
আমাদের দেশে আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলে না, বলা যায় চলতেও দেয়া হয় না। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হলেও কার্যত বিচার বিভাগ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন হতে পারেনি। সে কারণে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব রয়ে গেছে। রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানের আদলে বিচার বিভাগও ক্ষমতাসীন সরকারের ক্রীড়নকে পরিণত। বিচারকের দায়িত্বে বহাল থেকে জনৈক বিচারক সংসদ সদস্য হওয়ার অভিলাষে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষে শিষ্টাচারবহির্ভূত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করে স্বীয় পদকে করেছিলেন বিতর্কিত-কলুষিত। ভুয়া বা জাল সার্টিফিকেটধারী আইনজীবীকে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক পদে নিয়োগ দেয়ার চাঞ্চল্যকর কাহিনিও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। আর্থিক ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে আমাদের বিচার বিভাগের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল এই বিচার বিভাগ ক্রমেই মানুষের আস্থা-ভরসা হারিয়েছে, যেটা কারো কাম্য ছিল না।
আমাদের দেশের বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম বিচার বিভাগ ও বিচারপতিরা। রাষ্ট্রের অনেক অবৈধ অপকর্মের সহযোগী প্রধান বিচারপতি থেকে কতিপয় বিচারক পর্যন্ত। ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্টে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বিচারপতি-প্রধান বিচারপতিরাই। প্রয়াত সায়েম সাহেব, সাত্তার সাহেব অবৈধ সামরিক সরকারগুলোকে আইনি বৈধতায় অসাংবিধানিক উপায়ে দেশের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ধ্বংসে যুক্ত হয়েছিলেন। হাইকোর্ট এক রায়ে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯১-এর পূর্ববর্তী সব সামরিক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। অর্থাৎ অবৈধ সেসব সামরিক সরকারের সঙ্গে যুক্ত প্রধান বিচারপতিরাও অবৈধ অপকর্মের সহযোগী ছিলেন এবং তারা যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি-উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সেটাও অবৈধ ও অসাংবিধানিক। দেশের সংবিধান জ্ঞাত প্রধান বিচারপতিরা না জেনে-বুঝে নিশ্চয় অবৈধ সামরিক সরকারগুলোর বৈধতা প্রদানসহ তাদের সহযোগী হননি! প্রধান বিচারপতি সায়েম বিচারকের আসনে বসে লিখেছিলেন, ‘পর্যাপ্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার ছাড়া আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যেতে পারে না।’ অবৈধ সামরিক জান্তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হয়ে সেই প্রধান বিচারপতি সায়েম সাহেবই দেশপ্রেমী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহেরের প্রহসন বিচারের ‘মৃত্যুদণ্ড’ রায় সমর্থন করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। ক্ষমতার মোহে যদি দেশের প্রধান বিচারপতিরা বেআইনি ক্ষমতার পিছু নেন, তাহলে তাদের প্রতি দেশবাসীর আস্থা-ভরসা থাকবে কী করে? সামরিক শাসক এরশাদীয় যুগের পতনের পর আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকরা সৎ-নির্মোহ দল নিরপেক্ষ যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বের করলেন বিচার বিভাগের প্রধান বিচারপতিকেই। তার অধীনেই ১৯৯১ সালের নির্বাচন হয়েছিল। পরবর্তীতে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ৩ মাস মেয়াদি অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কয়েকটি নির্বাচন দেখেছি। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল নির্বাচনে পরাজিত দল। যে দল হেরেছে প্রতিবারেই সেই দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তুলাধুনা করে ছেড়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিরপেক্ষতার স্বীকৃতির পূর্বশর্ত ক্ষমতাপ্রাপ্তি। সেটি অর্জিত হলে ঠিক, নয়তো বেঠিক।
জাতীয় নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানরা প্রতিবারই ভোট প্রদান করেছেন। সে ক্ষেত্রে তাদের নিরপেক্ষতা রক্ষা হয়েছিল কী? স্বীকার করতেই হবে, অতীতের নির্বাচিত, অনির্বাচিত সরকারের শাসনামলের বিচার বিভাগের ওপর কর্তৃত্ববাদী সরকার হিসেবে বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে সব রেকর্ড ভেঙেছে। এরূপ নগ্ন হস্তক্ষেপ আগে দেখা যায়নি। কেবল বিচার বিভাগ নয়, রাষ্ট্রের স্বাধীন এবং সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের যে দৃষ্টান্ত রেখেছিল, সেটা দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পাবে। রাজতান্ত্রিক শাসনামলকেও হার মানিয়েছিল।
আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের লিপিবদ্ধ থাকার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর ওপর সর্বময় ক্ষমতা প্রদানের কথাও। এই সংবিধান যে গণতান্ত্রিক নয়, এ নিয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। ওই সংবিধান ও বিদ্যমান ব্যবস্থা বদলানো না গেলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনোই সুযোগ নেই।
আলোচিত বিচারপতি এম এ আজিজ। জোট সরকার কর্তৃক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর নানা বিতর্ক-ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন। তার অপসারণে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোট এমনকি সুশীল সমাজসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের জোর দাবির মুখেও তিনি চরম নির্লজ্জতায় স্বপদে আঁকড়ে থেকেছেন। একজন বিচারপতি হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা পর্যন্ত হয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ হাওয়া ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আদেশ-নির্দেশে উঠবস করে ‘বিচারপতি’ পদমর্যাদাকে চরমভাবে কলুষিত করেছেন।
দেশের স্বনামধন্য বিচারপতিরা বিচারব্যবস্থায় নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন সরকারগুলো যেমন রাজনৈতিক স্বার্থে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে, একইভাবে তাদের শিকারে পরিণত বিচার বিভাগও। বিচারক নিয়োগে-পদোন্নতি সরকারের হাতে যতদিন থাকবে ততদিন বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে না। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে কর্তৃত্ব মুক্ত না করা পর্যন্ত বিচার বিভাগের নানা অসঙ্গতি-বিতর্কের অবসান হবে না। আমাদের মূল সংবিধানের ৯৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা সম্ভব না হলে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ পৃথক করা যাবে না। বহু বিতর্কিত চতুর্থ সংশোধনী বাতিল না করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা যাবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা শেষ কথা নয়। সব সংকট নিরসনে শাসক শ্রেণি উদ্যোগ গ্রহণ করবে- সেটাও ভরসা করা যাবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থা না পাল্টানো পর্যন্ত সবই একই নিয়মে চলবে। এটাই বাস্তবতা।
মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।