ই-রিটার্ন দেবার সহজ কৌশল

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোম্পানি ও ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের বার্ষিক আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন জমা দেয়ার সময়সীমা আরো এক মাস বাড়িয়েছে সরকার। নতুন আদেশ অনুযায়ী, ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতারা আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ও কোম্পানি শ্রেণীর করদাতারা নতুন বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয়কর বিবরণী জমা দিতে পারবেন। উল্লেখ্য, এবার ঘরে বসেই অনলাইনে সহজেই আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে।
ই-রিটার্ন দাখিলের জন্য কি কি প্রয়োজন
এনবিআর (ন্যাশনাল বোর্ড অফ রেভেনিউ)-এর ইলেক্ট্রনিক ট্যাক্স রিটার্ন সিস্টেমটি ব্যবহারের জন্য দরকার হবে একটি বায়োমেট্রিক করা মোবাইল নাম্বার এবং ই-টিন নম্বর। মোবাইল নাম্বারটি জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি কার্ডের সঙ্গে যুক্ত আছে কিনা তা যাচাই করা হবে।
বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের জন্য মোবাইল থেকে *১৬০০১# নাম্বারে ডায়াল করতে হবে। এরপরে এনআইডির সর্বশেষ চারটি সংখ্যা উল্লেখ করে সেন্ড করতে হবে। মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে এনআইডি নাম্বারের সঙ্গে সংযুক্ত ফোন নাম্বারের তালিকা পাঠানো হবে। এই নাম্বারগুলো প্রত্যেকটি বায়োমেট্রিক করা হতে হবে। অন্যথায় এই তালিকা সম্বলিত মেসেজ আসবে না।
ই-রিটার্নের সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে আলাদা করে কোনো কাগজপত্র দিতে হয় না। কেবল প্রয়োজনীয় তথ্যা নির্ভুলভাবে দিতে হয়। তাছাড়া কর অফিস থেকে যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি তথ্য-প্রমাণ যেন দেখানো যায় তার জন্যও কাগজপত্র আগে থেকেই প্রস্তুত রাখা জরুরি।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দিবেন যেভাবে
ই-ট্যাক্স এনবিআর সাইটে নিবন্ধনের জন্য লগ ইন করতে হবে ই-রিটার্ন ওয়েবসাইটে (যঃঃঢ়ং://বঃধীহনৎ.মড়া.নফ/)। এখানে প্রদত্ত পরিষেবাগুলো থেকে “ই-রিটার্ন” অপশনে গেলে একটি নতুন উইন্ডো আসবে, যেখানে সাইটটিতে নিবন্ধন করা আছে কিনা - তা জানতে চাওয়া হবে। এখানে “আই অ্যাম নট ইয়েট রেজিস্টার্ড” বাটনে ক্লিক করা হলে নিবন্ধন পেজে নিয়ে যাওয়া হবে। এই সাইনআপ পেজে ১২ সংখ্যার টিন নাম্বার,বায়োমেট্রিক করা মোবাইল নাম্বার এবং ক্যাপচা সঠিকভাবে পূরণ করে “ভেরিফাই” তে ক্লিক করতে হবে।
এরপর ফোন নাম্বারে মেসেজের মাধ্যমে ছয় অংকের একটি ওটিপি কোড আসবে। এটি সাইনআপ পেজের নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে পরপর দুইবার একটি নতুন পাসওয়ার্ড সরবরাহ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে,পাসওয়ার্ডটি অবশ্যই আলফানিউমেরিক অর্থাৎ অঙ্ক, অক্ষর ও বিভিন্ন চিহ্ন সম্বলিত হতে হবে। সহজ বা ছোট পাসওয়ার্ড গ্রহণযোগ্য নয়। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড দিয়ে সাবমিট করার সঙ্গে সঙ্গেই ই-রিটার্ন অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়ে যাবে।
এখানে মনে রাখতে হবে যে, ই-টিন যেহেতু এনআইডি দিয়ে করা হয় তাই এই সিস্টেমে দেওয়া নাম এবং মোবাইল নাম্বারের সঙ্গে বায়োমেট্রিক করা ব্যক্তির নাম একই হতে হবে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি তার নিজের বায়োমেট্রিক ভেরিফাই করা ফোন নাম্বার দিয়ে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তা থেকে অন্যজনের রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন না।
নিবন্ধনের পর এবার সেই টিন নাম্বার,পাসওয়ার্ড ও নতুন ক্যাপচা পূরণ করে সাইন ইন করলে ই-রিটার্ন ড্যাশবোর্ডটি দেখা যাবে। ড্যাশবোর্ডে বাম পাশের মেনু বারে “সাবমিশন” মেনুতে রয়েছে দুই ধরনের রিটার্ন পেজ। একটি সিঙ্গেল পেজ ও অপরটি রেগুলার রিটার্ন পেজ।
সিঙ্গেল পেজ রিটার্ন
প্রধানত ৭টি শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এক পেজ-এ রিটার্ন জমা দেওয়া যেতে পারে। সেগুলো হলো:
বার্ষিক করযোগ্য আয় অনূর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা
সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ ৫০ লক্ষ টাকার কম
গণকর্মচারী নন
মোটরগাড়ির মালিকানা নেই
সিটি করপোরেশনে কোনো বাড়ির মালিকানা নেই
বিদেশে কোনো পরিসম্পদ নেই
কোনো কোম্পানির শেয়ার নেই
এই মাধ্যমে এক পেজের মধ্যেই রিটার্নের যাবতীয় তথ্য দিয়ে খসড়া করা যায়। এর মধ্যে থাকে আয়ের উৎস, মোট আয়, জীবনযাপন ব্যয়, সামগ্রিক পরিসম্পদ, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, উৎসে কর্তিত কর, প্রদেয় কর এবং রিটার্নের সঙ্গে দেওয়া কর। সব তথ্য প্রদান শেষে পেজটি ড্রাফট হিসেবে রাখা যায়, আবার “সাবমিট” বাটনে ক্লিক করে সঙ্গে সঙ্গেই অনলাইন জমা সম্পন্ন করা যায়।
রেগুলার ই- রিটার্ন
উপরোক্ত সাতটি শর্তের বাইরে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তিকেই এই বিস্তারিত রিটার্ন পদ্ধতিতে অগ্রসর হতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় কর যাচাই, আয়-ব্যয়, বিনিয়োগ, সম্পদ, ঋণ এবং কর রেয়াতের মতো সনাতন পদ্ধতির বিষয়গুলো বিস্তারিত তথ্যের জন্য পৃথক স্ক্রিনে দেখানো হবে।
কর যাচাইয়ের তথ্য
এ অংশে প্রথমেই রিটার্ন স্কিম ঘরে সেল্ফ, এসেস্মেন্ট বর্ষ ও ইনকাম বর্ষের ঘরে সাল ও তারিখ পূর্ব নির্ধারিত থাকবে। আয় করমুক্ত হলে আয়ের পরিমাণের পাশাপাশি “রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস” উল্লেখ করে দিতে হবে।
ডানপাশের হেডস অব ইনকামের নিচে যে অপশনগুলো রিটার্নদাতার জন্য প্রযোজ্য শুধুমাত্র সেগুলোতেই তিনি টিক দেবেন। এই হেডগুলোর মাধ্যমে ব্যক্তির আয়ের উৎস বা খাত নির্ধারিত হয় এবং সে অনুসারে পরের স্ক্রিনগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য একদম নিচের দিকে রয়েছে “সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ” বাটন।
অতিরিক্ত তথ্য
পূর্বের স্ক্রিনে প্রদত্ত তথ্যের জের ধরে এখানে যাচাই করার জন্য আরও বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়। যেমন কাজের স্থান, মুক্তিযোদ্ধা বা প্রতিবন্ধী কিংবা অন্য প্রতিবন্ধীর আইনি অভিভাবক কি না, বিনিয়োগের জন্য কর রেয়াত, কোনো কোম্পানির শেয়ার আছে কি না, মোটরগাড়ি বা সিটি করপোরেশনে নিজস্ব বাড়ি ইত্যাদি।
আইটি১০বি
এই সেকশনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আইটি১০বি। যাবতীয় সম্পদের পরিমাণ যদি ৪০ লাখ টাকা বা তার বেশি হয় সেক্ষেত্রে এই হেডটিতে টিক মার্ক দিতে হবে। প্রদত্ত পরিমাণ সম্পদ না থাকলে আর এই অপশনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে এক্ষেত্রে ব্যক্তির পরিবারের বার্ষিক খরচের হিসেব অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এরপর “সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ” দিয়ে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার পর একে একে এসেস্মেন্ট, ইনকাম, এক্সপেনডিচার, এসেট্স অ্যান্ড লায়াবিলিটিস এবং ট্যাক্স অ্যান্ড পেমেন্ট ট্যাবগুলোর ভিন্ন ভিন্ন পেজগুলো আসবে।
আয়ের বিস্তারিত বিবরণ
এখানে রয়েছে বৈদেশিক আয় বা কর-অব্যাহতি এবং বেতন বা করযোগ্য বিনিয়োগ ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে আয়। “এনি আদার ইনকাম” অপশনে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্যসহ অন্যান্য আয়ের উৎস এবং সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের হিসেব যুক্ত হবে। এই তথ্যগুলো নেট আয়ের হিসাবে যুক্ত হবে।
ব্যয়ের খাত
এই বিভাগটিতে সারা কর বছরে মোট আয়ের বিপরীতে প্রতিটি ব্যয়কে একসঙ্গে করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালি ও ইউটিলিটিসহ বাসস্থান, খাদ্য, পোশাক, পরিবহন, বাচ্চাদের স্কুল খরচ এবং অন্যান্য বিবিধ ব্যয়।
সম্পদ, ঋণ ও বিনিয়োগ খাত
এখানে যুক্ত হবে বিমা, ডিপোজিট প্রিমিয়াম সার্ভিস, সঞ্চয়পত্র, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং স্টক বা শেয়ারসহ যাবতীয় বিনিয়োগগুলো। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি অপশনের সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে রয়েছে স্পষ্ট ও বিস্তারিত তথ্য প্রদানের জায়গা।
কর ও পরিশোধ
সামগ্রিক রিটার্নে কোনো করযোগ্য আয় বা বকেয়া অথবা অগ্রিম কর থাকলে তার স্বয়ংক্রিয় হিসাব হবে এই অংশে। উৎসে কর্তনকৃত কর এবং অগ্রিম কর প্রদান করা হলে তা নেট হিসেবে বাদ যাবে। আয়ের উপর কোনো কর বকেয়া বা ধার্য না হলে প্রদেয় করের পরিমাণ শূন্য হবে আর এভাবে প্রদান করা রিটার্ন “শূন্য রিটার্ন” নামে পরিচিত।
যাবতীয় ডেটা সরবরাহের পর ট্যাক্স পেমেন্ট স্ট্যাটাসে ক্লিক করলে কর হিসাবের একটি সারাংশ দেখানো হবে। অতঃপর কোনো করযোগ্য পরিমাণ উল্লেখ থাকলে এবার তা পরিশোধের পালা। এর জন্য “পে নাউ” বাটনে ক্লিক করলে অর্থপ্রদানের জন্য কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিং; এই তিনটি অপশন প্রদর্শিত হবে। এগুলোর যেকোনোটি নির্বাচন করে নেট কর তাৎক্ষণিকভাবে পরিশোধ করা যাবে।
ই-রিটার্ন সনদ সংগ্রহ
রিটার্ন জমা দেওয়ার পর কর প্রদানের রশিদ ও রিটার্ন সনদসহ প্রত্যেকটি ট্যাক্স রেকর্ড সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তুত হয়ে যাবে। এই গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো যেকোনো সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে এখান থেকে ডাউনলোড এবং প্রিন্ট করে কাজে লাগানো যাবে। উল্লেখ্য, অনলাইনে রিটার্ন জমা দিলে করদাতা ও এনবিআরের কর কর্মকর্তাদের সরাসরি দেখা হবে না। এতে দুর্নীতি বন্ধ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অনলাইনে সহায়তা
কোনো করদাতা অনলাইনে নিবন্ধন ও রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনো সমস্যায় পড়েন, তাহলে এনবিআরের কল সেন্টারের সহায়তা নিতে পারেন। এ-সংক্রান্ত কল সেন্টার প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চালু আছে। কল সেন্টারের নম্বর ০৯৬৪৩৭১৭১৭১। কল সেন্টারে ফোন করলে একজন কর কর্মকর্তা আপনার সমস্যার সমাধান করে দেবেন।