প্রাণ প্রকৃতি স্বাস্থ্য রক্ষায় প্লাস্টিক বর্জন এর বিকল্প নাই

সামিউল হাসান সজীব
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১০:২৫ এএম

সামিউল হাসান সজীব। ছবি : ভোরের কাগজ
আলেকজান্ডার পার্কিস নামের একজন বৃটিশ বিজ্ঞানী ১৮৬২ সালে সেলুলোজ থেকে প্লাস্টিক তৈরি করেছিলেন। প্লাস্টিক বা পলিথিন হল একটি কৃত্রিম বস্তু যা তৈরি হয় রাসায়নিক দ্রব্য থেকে। কম খরচ, সহজ উৎপাদনযোগ্যতা, বহুমুখীতা, পানির সাথে সংবেদনহীনতা ইত্যাদি কারণে প্লাস্টিক কাগজের ক্লিপ থেকে মহাকাশযানের বিভিন্ন ধরনের বহুমুখী পণ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানের অসীম অবদান। কিন্তু এই বিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টের কারণ হয়ে ওঠেছে। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো প্লাস্টিক বর্জ্য। প্লাস্টিক সহজে বহনযোগ্য এবং দামে অপেক্ষাকৃত সস্তা হওয়ায় দৈনন্দিন প্রায় সব কাজেই এটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই দ্রব্যটি অপচনশীল হওয়াতে প্রকৃতির জন্য হয়ে উঠেছে হুমকিস্বরূপ। কারণ কোমল পানীয়ের বোতল, টুথব্রাশ, বিভিন্ন খেলনা প্রভৃতি প্লাস্টিকের দ্রব্য প্রায় ২০০ বছর পর্যন্ত অপাচ্য থাকে।
এছাড়া বাজারে পণ্য বহনের সুবিধার্থে যে প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া যায় সেটি প্রায় ২০০ থেকে ৫০০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। এ কারণে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে প্লাস্টিক পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অনীহা এবং আইন কার্যকরের অভাবে এর প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ২৫ শতাংশ প্লাস্টিক অপরিবর্তিত থাকে। অর্থাৎ পুনর্ব্যবহার হয় না এবং পরিশেষে তা সমুদ্রে পতিত হয়। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়।
ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পলিথিনকে দায়ী করা হয়। যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং নদী-নালার ধারণক্ষমতা কমে যায়। প্লাস্টিক পরিবেশ থেকে কখনো হারিয়ে যায় না। একসময় আমাদের খাদ্যের সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিনের কণা বৃষ্টির পানির সঙ্গে নদী, হ্রদ ও সমুদ্রে চলে যায়। প্লাস্টিক তৈরিতে প্রায় ৩৮ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৮টি অত্যন্ত ক্ষতিকর।
গবেষকরা বলছেন, প্লাস্টিক বা পলিথিনে গরম পানি বা গরম খাবার ঢালার সঙ্গে সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিসফেলন-এ তৈরি হয়। বিসফেনল-এ থাইরয়েড হরমনকে বাধা দেয়। বাধাপ্রাপ্ত হয় মস্তিষ্কের গঠনও। গর্ভবতী নারীদের রক্ত থেকে বিসফেনল-এ যায় ভ্রুণে। ফলে নষ্ট হতে পারে ভ্রুণ, দেখা দিতে পারে বন্ধ্যাত্ব। শিশুও হতে পারে বিকলাঙ্গ। তাছাড়া ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার ১০ কারণের মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিকের ব্যবহার। ২০২০ সালেই বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক শিল্প থেকে ১.৮ বিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইডের সমপরিমাণ গ্যাস বের হয়েছে, যা কি না ৩৮০টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমান। এগুলো শ্বাসনালির প্রদাহ, অ্যাজমা এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
অথচ পলিথিন ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এদিকে পলিথিন ও প্লাস্টিক–বর্জ্য উৎপাদনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে বাণিজ্যিকভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার শুরু হয়। ধীরে ধীরে প্লাস্টিক ও পলিথিনের তৈরি করা নানা ধরনের সামগ্রী ধনি-গরিব সবার জন্যই অপরিহার্য বস্তুতে পরিণত হয়।পলিথিনের ভয়ানক ক্ষতির দিক চিন্তা করেই ১ জানুয়ারি ২০০২ থেকে ঢাকা শহরে এবং ১ মার্চ ২০০২ সাল থেকে সারাদেশে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের সেই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই আশার সঞ্চার করেছিল। সে সময় বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি সামগ্রীর দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়তে শুরু করেছিল, কাগজের তৈরি ঠোঙার ব্যবহারও বেড়ে গিয়েছিল।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে ইংরেজি অক্ষরের চারটি আর অর্থাৎ রিফিউজ বা প্রত্যাখ্যান করা, রিডিউস বা ব্যবহার কমানো, রিইউজ বা পুনরায় ব্যবহার এবং রিসাইকেল বা পুনরুৎপাদনের প্রতি জোর দিতে হবে। এই দ্রব্যের পরিপূরক দ্রব্য তথা পাটজাত এবং অন্যান্য দ্রব্য ব্যবহারের ব্যাপারে জনগণকে সচেষ্ট হতে হবে। তাছাড়া যেখানে সেখানে এসব বর্জ্য না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। প্লাস্টিক দ্রব্যের পুনর্ব্যবহার কারুশিল্পেরই একটা অংশ। তাই এই দ্রব্যটি দ্বারা কৃত্রিম ফুল, খেলনা, উদ্যান ভাস্কর্যসহ অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে এবং সৌন্দর্যবর্ধনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
কয়েক বছর আগেও প্লাস্টিকের চালের বস্তার পরিবর্তে পাটের বস্তার ব্যবহার করার জন্য আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করা হয়েছে। ঠিক তেমনি অন্যান্য দ্রব্যের ক্ষেত্রেও একই আইন প্রণয়ন করলে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকাংশে কমানো সম্ভব। অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা প্লাস্টিক দ্রব্য রিসাইকল করে নতুন রূপ দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অপরদিকে, আইনের পরিধি আরও বাড়িয়ে পলিথিন ব্যবহারের জন্য জরিমানা এবং অন্যান্য শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাগজ বা পাটের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা গেলে হয়তো পাটকলগুলোকে রক্ষা করা যাবে। পলিথিন ও প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদনের যথার্থতা নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও কঠোর হতে হবে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। তাহলেই হয়তো আমরা একটা নিরাপদ বাসস্থান রেখে যেতে পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।