সমুদ্রে মরণযাত্রার দায় কার

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৫১ এএম

ফাইল ছবি
ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়ে ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি দেয়ার করুণ পরিণতি
এক বুক স্বপ্ন নিয়ে পরিবারের অভাব ঘোচাতে ধারদেনা করে দুবাই যান হবিগঞ্জের বানিয়াচং দক্ষিণ নন্দীপাড়ার মৃত তাজ উল্লার পুত্র আবিদ হোসেন (২০)। দুই বছর আগে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ভিজিট ভিসায় সেখানে গিয়ে কর্মী ভিসা পান তিনি। কিন্তু প্রত্যাশামতো সুবিধাজনক কাজ পাননি এখনো। একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে শ্রমিকের কাজ মিললেও ছয় মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না।
বাড়িতে টাকা পাঠানো দূরের কথা; অভাব অনটনে ধারদেনা করে খেয়ে না খেয়ে তার দিন কাটছে দুবাইয়ের আলকুচ এলাকার মেসে। রোজার মাসে সেহেরি ও ইফতার করতে হচ্ছে বিভিন্ন মসজিদে। ছয় ভাই দুই বোনের সংসারে সবার ছোট আবিদ যে স্বপ্ন নিয়ে দুবাই যান- এখন সেই স্বপ্ন তার কাছে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। দুবাইয়ের আলকুচ শহর থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাগ্যবিড়ম্বনার এমন করুণ কাহিনী জানিয়েছেন আবিদ। শুধু আবিদ নয়; এমন অনেক তরুণের দুর্বিষহ জীবন কাটছে দুবাইয়ের আনাচে কানাচে, মেসে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অনেকে মানবপাচার চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার আশায় সাগর পথে মরণযাত্রার ঝুঁকি নিচ্ছে। অনেককে আবার লিবিয়ায় আটকে রেখে দেশের স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে লাখ টাকা।
দুবাইয়ে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ থাকলেও দুই বছরে আড়াই লাখের অধিক লোক সেখানে গেছে ভিজিট ভিসায়। এক থেকে তিন মাস মেয়াদি এই ভিসায় সেখানে গিয়ে কতজন লোক দেশে ফিরেছে তার সঠিক হিসাব নেই কারো কাছে। কাজ দেয়ার কথা বলে ‘ভিজিট ভিসায়’ তাদের দুবাই নেয়া হলেও সেখানে গিয়ে মিলছে না কোনো কাজ। এ অবস্থায় নিরুপায় হয়ে তারা প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে মরণযাত্রা করছেন। অনেকে যাচ্ছেন ভিন্ন কোনো দেশে। যার পুরোটাই হচ্ছে অবৈধ প্রক্রিয়ায়। অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমাতে দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি দুবাইয়ে ঢুকেছে। করোনার আগে ও পরে এসব বাংলাদেশি ভিজিট ভিসায় সেখানে পৌঁছে। আর দুবাইকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে তারা অবৈধভাবে পাড়ি দিচ্ছে ইতালি, স্পেন, গ্রিস, ফ্রান্স, তুরস্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ভিজিট ভিসার মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে দুবাই থেকে লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো ও অন্যান্য আফ্রিকান দেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে তারা! দুবাইয়ের দেইরা এলাকার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে যেন ছোট্ট এক টুকরো বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। সেখানে বার ও ড্যান্স ক্লাবে গেলেই দেখা মেলে অনেক বাংলাদেশি তরুণীর। ওই এলাকা ঘুরলে বাংলাদেশিদের প্রতারিত হওয়া ও মানবপাচারের শত শত করুণ গল্প কানে ভেসে আসে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেছেন, যে যায় দায় তারই। সে জেনেবুঝে টাকা দিয়ে ভিজিট ভিসা নেয়। কাজ দেয়ার কথা বলেই তাদের দুবাই নেয়া হয়। এরপর কাজ না পেলে তারা যে পথে পা বাড়ায়, তার দায় তাদেরই।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম জানান, ২০১৯ সালে ৭২টি মানবপাচার মামলার তদন্তভার পেয়েছি আমরা। এর মধ্যে ৬৭টির তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালে আমাদের কাছে এসেছে ৬৩টি মামলা আর প্রতিবেদন দিয়েছি ৫১টির। ২০২১ সালে তদন্তভার পেয়েছি ৫১টি মামলার, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি ৬০টির। আর ২০২২ সালে তদন্তভার পেয়েছি ৩০টির এবং তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছি ৪৫টি মামলার।
তিনি বলেন, লিবিয়া, মরক্কো, ইরান, তুরস্ক ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে মানবপাচার হচ্ছে। দুবাইকে বিশেষ করে ট্রানজিট শহর হিসেবে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। পাচার ঠেকাতে ২০২০ সাল থেকে সিআইডির ৭ সদস্যের একটি টিম সার্বক্ষণিক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাজ করছে। সেখানে ভিকটিম পেলে তাদের কাছ থেকে অভিযোগ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।
তিনি বলেন, প্রতি বছর মানবপাচারের ৭০টি মামলা নিষ্পত্তি করে সিআইডি। পর্যবেক্ষণ মতে, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের লোকজন ইতালি যেতে বেশি আগ্রহী। তারাই প্রতারিত হচ্ছে বেশি। মানবপাচারের অভিযোগে প্রতিনিয়ত ভিকটিম পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভিজিট ভিসায় গিয়ে যারা প্রতারিত হচ্ছেন তারা অনেকটা জেনেবুঝে ঝুঁকি নিয়েই ফাঁদে পা দিচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম আখতারুজ্জামান জানান, অসহায় লোকজন লোভে পড়ে ঝুঁকি নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। উন্নত জীবন ও উপার্জনের জন্য ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে যেতে প্রলুব্ধ হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের অক্টোবর মাস থেকে দুবাই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না। এ অবস্থায় করোনাকালে (২০২০ সালে) ভিজিট/ট্যুরিস্ট ভিসা চালু করলে একটি চক্র মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারের রুট হিসেবে দুবাইকে বেছে নেয়। ইমিগ্রেশন পুলিশ বিষয়টি বুঝতে পারলে সন্দেহভাজন ‘ভিজিট ভিসাধারী’দের বিমানবন্দরে আটকে দেয়। আরব আমিরাতের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালককে (কনস্যুলার ও কল্যাণ) পত্র পাঠিয়ে পুলিশের এমন তৎপরতা বন্ধের অনুরোধ করা হয়। ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর সেখানকার কনসাল জেনারেল ইকবাল হোসেন খান স্বাক্ষরিত পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ৮ বছর শ্রমিক ভিসা বন্ধ থাকার পর দুই মাস ধরে বাংলাদেশিরা ভিজিট ভিসায় এসে কর্মী ভিসা লাগানোর সুযোগ পাচ্ছে। এই সুযোগে বাংলাদেশি প্রবাসীরা তাদের স্বজন ও পরিচিতদের দুবাই এনে কাজের ব্যবস্থা করছে।
সিকিউরিটি গার্ড, ক্লিনার, গাড়িচালক, কুক, কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার, গৃহপরিচারক/পরিচারিকা, সেলসম্যান, কারওয়াশ, হাউজকিপিং, টি-বয় ক্যাটাগরিতে প্রায় ৫০ হাজার কর্মীর চাহিদা রয়েছে। যাদের বেতন এক থেকে আড়াই হাজার দিরহাম হবে। ওই পত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিজিট ভিসায় আসতে লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে। ওই বছরের ৩১ নভেম্বর দুবাই আরব আমিরাত বাংলাদেশ বিজনেস এসোসিয়েশন সভাপতি মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক এস এম শওকত আলী মোল্লা দুবাই ও উত্তর আমিরাতের কনসাল জেনারেলকে পত্র দিয়ে ভিজিট ভিসাপ্রাপ্তদের বিমানবন্দরে হয়রানির অভিযোগ করেন। এর আগে একই অভিযোগে তারা প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেন। নানাবিধ চাপের মুখে ভিজিট ভিসাধারীদের বিমানবন্দরে আর বাধা দেয়া হয়নি। তবে এমন ভিসা নিয়ে দুবাই যাওয়া আড়াই লাখের অধিক কর্মীর কেউই আর দেশে ফেরেনি। দুই লাখ টাকা দিয়ে ভিজিট ভিসা পেয়ে কাজের খোঁজে সেখানে গিয়ে হতাশায় ডুবেছেন। বাধ্য হয়ে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। ধরা দিচ্ছেন মানবপাচারকারী চক্রের কাছে। পরিসংখ্যান বলছে, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপ যাওয়ার পথে ২০২১ সালে স্পেনে প্রবেশ করতে গিয়ে যেসব দেশের নাগরিক আটক হয়েছেন তার মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়। ২৪ হাজার ৬৪৭ জন বাংলাদেশি সেখানে আটক হয়েছেন। এক দশকে এমন বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিজিট ভিসায় যারা দুবাই গেছেন তারা কেউই গোপনে বা পালিয়ে যাননি। তাহলে কেন তারা ফেরেনি, তারা কোথায় আছে, কোথায় গেছে, কীভাবে গেছে- এর দায় তাহলে কার? হতাশায় ডুবে মরণযাত্রায় যারা লাশ হচ্ছেন তাদের দায় কি ওই সময়ে যারা পত্র দিয়েছিলেন তারা নেবে?
ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, যারা বিদেশে যায় তাদের আরো সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশে গিয়ে কাজ করা যায় না- এটা মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশের যেসব তদারকি কর্তৃপক্ষ আছে তাদের আরো তৎপর হতে হবে। তিনি মনে করেন, কাজের ভিসা নিশ্চিত না করে ভিজিট ভিসার লোক যেতে দেয়া ঠিক হয়নি। এর মধ্য দিয়ে অনেকে মানবপাচারের শিকার হয়েছে। অনিয়মিত অভিবাসনের কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। মানবপাচারের মাধ্যমে অর্থও পাচার হচ্ছে। মানবপাচার রোধে সফলতা পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকটি ইউনিটকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
এদিকে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও একইভাবে দুবাই গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন। দেইরাসহ বিভিন্ন এলাকায় নারীদের বদ্ধঘরে আটকে রেখে বারে নিয়ে ব্যবহার ও অসামাজিক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের আপত্তিকর অবস্থার ছবি ও ভিডিও তৈরি করে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। দুই বছর আগে দুবাইয়ে মানবপাচারের অভিযোগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি। দুবাইয়ে পাচারের জন্য ঢাকা থেকে অপহৃত শিশুকে উদ্ধার করেছে র্যাব-৭। এ সময় এক নারীসহ তিন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি রাত ২টায় চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানাধীন চৌধুরীপাড়া এলাকা থেকে ওই শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মানবপাচারসংক্রান্ত ৫৩৮টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে গুটিকয়েক রয়েছে লিবিয়া থেকে মানবপাচার ঘিরে। সেই বছর সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্যোগী হয়ে পাচারকারীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। অভিবাসন বিশ্লেষকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ করার জন্য ১৮টির মতো পথ ব্যবহার হয়। সব হারিয়ে ফেরার কোনো উপায় না দেখে আবার পা পাড়াচ্ছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর দিকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর ও পারস্য উপসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাচ্ছে গ্রিস, স্পেন, ইতালি ও তুরস্কের মতো দেশে। দুর্গম মরুভূমি ও গভীর সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছাতে প্রতি বছর বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটতে হচ্ছে অনেককে।
বাংলাদেশ থেকে দালালের মাধ্যমে দুবাই হয়ে ইউরোপ যাওয়ার আগে মরক্কো, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, ইরান ও আলবেনিয়ার মতো দেশগুলোতে ঢুকছে তারা। আর ভয়ংকর ঝুঁকির এই যাত্রাপথে তাদের অনেকেই মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে পাসপোর্ট, টাকাপয়সা সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। শিকার হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতনের। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জিম্মি করে দেশে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মুক্তিপণ।