
প্রিন্ট: ০৩ জুন ২০২৫, ০৪:০৬ এএম
আরো পড়ুন
৬ বছর ধরে আবুল হোসেনের দখলে গুলশানের ক্যাপিটাল ক্লাব

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৯ পিএম

গুলশানের দি ক্যাপিটাল রিক্রিয়েশন ক্লাব লিমিটেডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া সভাপতি মোহাম্মাদ আবুল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের দি ক্যাপিটাল রিক্রিয়েশন ক্লাব লিমিটেড গত ৬ বছর ধরে দখলে রেখেছেন ক্লাবটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া সভাপতি মোহাম্মাদ আবুল হোসেন। দীর্ঘ সময় ক্লাবের দায়িত্ব থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে জমি কেনাসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি তার সভাপতির মেয়াদ শেষ হলেও তিনি নির্বাচন দিচ্ছেন না এবং নিজের পদও ছাড়ছেন না।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ক্লাবটি ঢাকার গুলশানে প্রতিষ্ঠিত হয়। সাবেক সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন গুলশান-বনানী কেন্দ্রিক স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে বাড়ি-১২, রোড-৭১, গুলশান-২ ঢাকাতে সামাজিক ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রথম দিকে ছোট পরিসরে ক্লাবটি যাত্রা শুরু করলেও ২০১৩ সালে এসে কেএমআর মঞ্জুরের নেতৃত্বে ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে ক্লাবের আমূল পরিবর্তন হয়। ক্লাবের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও কলেবর বৃদ্ধি করা হয় এবং ক্লাবকে আধুনিকভাবে সুসজ্জিত করা হয়।
২০১৮ সালে নিজেকে সভাপতি ঘোষণা দেন মোহাম্মদ আবুল হোসেন। এই বছরেই ক্লাবটি বারের লাইসেন্স পায়। ২০২২ সালে সভাপতি মোহাম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ক্লাব পূর্বাচল হোমল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট থেকে ক্লাবের অ্যাসেট হিসেবে ৪০ কাঠা জমি বায়না রেজিস্ট্রি করা হয়; যা ২০২৪ সালে ক্লাবের অনুকূলে হস্তান্তরিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে ক্লাবের একাধিক সদস্য জানান, ক্লাবের টাকা ব্যয় করে জমি কেনেন আবুল হোসেন এবং ভোগও করেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, কথিত পূর্বাচল হোমল্যান্ড ডেভেলপমেন্টকে এখন পর্যন্ত ২ কোটি টাকা দেওয়া হয়। আবুল হোসেনের যোগসূত্র থাকা এই কোম্পানি জমির কোন কাগজপত্র বুঝিয়ে দেয়নি এবং এ জমি বায়না সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণপত্র তিনি ক্লাবে দেখাতে পারেননি। এছাড়া ২০২৪ সালে এই ক্লাবের অনুকূলে জমি হস্তান্তরিত হওয়ার কথা থাকলেও ঠিক কবে হস্তান্তর হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তিনি প্রকাশ করেননি। এ বিষয়ে কেউ কিছু বললে তাকে ক্লাব থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন আবুল হোসেন।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের দি ক্যাপিটাল রিক্রিয়েশন ক্লাব লিমিটেড
২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এজিএম ও ক্লাবের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এক বছর মেয়াদি প্রথমবার নির্বাচিত এই পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন সভাপতি মোহাম্মদ আবুল হোসেন (ডিএম-৩৩), পরিচালক (এডমিনিস্ট্রেশন) কামরুল হাসান হান্নান (এলএম-২৪৪), পরিচালক (অর্থ) দেলোয়ার এইচ দুলাল (এলএম-২৭৫), পরিচালক ড. শামসাদ চৌধুরী সোনালী (এলএম-৩০৯), মোহাম্মদ মাহবুব হাসান গুড্ডু (এলএম-২০৮), মির মোঃ জাকির হোসেন মানিক (এলএম-২৭৮), মোঃ ছাইদ হাসান কানন (এলএম-১৯২), একেএম মাইনুদ্দীন নূরী মিল্কী (এলএম-২৯০), ইঞ্জিঃ মোঃ কামরুজ্জামান (এলএম-৩০৫), মাকসুদা খানম রীপা (এলএম-৩২৫) এবং মোঃ কবির হোসেন শান্ত (এলএম-৩১১)।
ক্লাবের একাধিক সদস্য অভিযোগ করে বলেছেন, আবুল হোসেন যখন তখন যেকোনো মেম্বারকে তার পছন্দ না হলে তার সদস্যপদ বাতিল করে দেন। ক্লাবটাকে তিনি নিজস্ব বিজনেস হাব হিসাবে ব্যবহার করেন। সকাল দশটা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত তিনি ক্লাবে অবস্থান করেন। ক্লাব দখলে নেওয়ার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ক্লাবের মদসহ সকল কেনাকাটা আবুল হোসেন নিজেই করে থাকেন। এই দায়িত্ব সে কোনোভাবেই অন্য কাউকে দিতে চান না। ক্লাবের বোর্ড মিটিংয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ গেলে তাকে প্রাণ নাশের হুমকি দেন। ক্লাবের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক গরমিল। রয়েছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগও।
২০২১ সালের ৫ নভেম্বর ক্লাবটিতে অভিযান পরিচালনা করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। অভিযানে বিপুল পরিমাণ মদ ও বিয়ার উদ্ধার করা হয়। তৎকালীন র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল-মোমেন জানান, অভিযানে সাড়ে চার শতাধিক দেশি ও বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৪০০ এর বেশি ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, ক্লাবের হল রুমে একটি মঞ্চ ছিল। সেখানে কার্পেট সরানোর পর একটি কাঠের কুঠুরি পাওয়া যায়। সেটি তালাবদ্ধ ছিল। তালা ভেঙে দেখা যায় মদের বোতল রাখা। মঞ্চের পাশে একটি শৌচাগারের ভেতর সিলিং সরানোর পর তালাবদ্ধ গোপন চেম্বার পাওয়া যায়। সেখানেও মদের বোতল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া দোতলা থেকে তিনতলা যেতে পেছনের দিকে সিঁড়ি রয়েছে। এর পাশে বড় একটি ছবি টাঙানো ছিল। সেই ছবি সরানোর পর আরো একটি গোপন চেম্বার পাওয়া যায়। সেই চেম্বারেও মদ পাওয়া গেছে।
অবৈধভাবে মদের ভাণ্ডার রেখে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন আবুল হোসেন। এদিকে র্যাবের এই অভিযান পরবর্তী ক্লাবের নামে মামলা হলে সেই মামলার খরচ বাবদও ক্লাব থেকে ব্যাপক অংকের টাকা লুটপাট করেন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ক্লাবটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া সভাপতি মোহাম্মাদ আবুল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী মাসের ২৮ তারিখে এজিএমে নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। দেশের নির্বাচন, কোরবানির ঈদ, ছাত্র-আন্দোলনসহ নানান প্রতিকূলতার কারণে তিনি নির্বাচন দিতে পারেননি বলে দাবি করেন।
নিজে মদ পান না করলেও গত ১০ বছর ধরে মদ কেনার দায়িত্ব তিনি কিভাবে পালন করছেন জিজ্ঞেস করলে বলেন, এসব মদ ইমপোর্ট করে আনা হয়; পর্যটন থেকে আনা হয়।
ক্লাবের নামে জমি কেনার বিষয়ে অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর না দিয়ে দেখা করতে বলেন। আবুল হোসেন বলেন, আমার ক্লাবে ১২০০ মেম্বার আছে। সবাই আমাকে পছন্দ নাও করতে পারে। এ জন্য কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে ভুল তথ্য ছড়াতে পারে।