অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, নোয়াখালী-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়শা ফেরদৌস ও যশোর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রনজিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ কর্মকর্তা) আকতারুল ইসলাম বলেন, দেশ-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এই তিনজনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে।

ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, আইভী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে আবুল হোসেনকে রাখা হয়। আবুল হোসেন ক্ষমতার অপব্যবহার ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে সিএনজি অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আইভীর নিজ নামে নারায়ণগঞ্জ মহানগরে রয়েছে ৪ থেকে ৫টি ফ্ল্যাট। তার ব্যক্তিগত সহকারী আরিফ হোসেনকে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করা হয়। তার গাড়িচালকের নামে নারায়ণগঞ্জ মহানগরের বরকল এবং পানিরকল এলাকায় ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে।

সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ এবং অপসারণ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোপাট করেন আইভীর দুই ভাই আলী রেজী রিপন এবং আহম্মদ আলী রেজা উজ্জ্বল। নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৭ তলাবিশিষ্ট একটি বিশাল আলিশান বাড়ি তৈরির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী একটি চিত্ত বিনোদন ক্লাব ভেঙে সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেছেন আইভী। বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৮ একর জমি দখল করে সেখানে শেখ রাসেল পার্ক নির্মাণ করেছেন। এসব সম্পদ ও দুর্নীতি ছাড়াও সাবেক মেয়র আইভীর নামে, তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিরা এবং তার নিকট আত্মীয়দের নামে অবৈধভাবে অর্জিত জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত আরো সম্পদ রয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে সত্যতা পেয়েছে দুদক। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান আলী আহাম্মদ চুনকার মেয়ে আইভী ২০১১ সালে প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বার ও সবশেষ ২০২১ সালে তৃতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন তিনি। তার বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

এদিকে নোয়াখালী-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আয়শা ফেরদৌসের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানা যায়, আয়শা ফেরদৌস ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে- হাতিয়া বাজারে বহুতল ভবন, ভূঁইয়ারহাট নামক স্থানে তিন তলা বাড়ি, পুশালী বাজারে চার তলা মার্কেট। তার স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর নামেও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ, নগদ অর্থ, ব্যাংকে টাকা, গাড়ি এবং মৎস্য ব্যবসাসহ নানা সম্পদ রয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের আগে আয়শা ফেরদৌস ছিলেন একজন গৃহিণী। তার আয়ের কোনো উৎস ছিল না। পরে এমপি নির্বাচিত হয়ে তার নিজ নামে ও নির্ভরশীলদের নামে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

অন্যদিকে যশোর-৪ আসনের সাবেক এমপি রনজিত কুমার রায় ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তার নিজ নামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ছিল ৪ লাখ ১০ হাজার টাকার। স্ত্রীর নামে ছিল ৭০ হাজার টাকা ও ১৫ হাজার টাকা মূল্যের ৫ তোলা স্বর্ণ। ২০২৩ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে নিজ নামে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার টাকা ও স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা। ছেলে রাজিব কুমার রায় প্রত্যেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি কাজের জন্য ৫ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন। রনজিত রায় তার নিজ ও ছেলের নামে ভারতের সল্টলেক এলাকায় বাড়ি করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জমি দখল, মানিলন্ডারিং, নিয়োগ বাণিজ্য ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানাবিধ দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য গোয়েন্দা তথ্যানুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।