রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থারও সংস্কার চায় পুলিশ

আজিজুর রহমান জিদনী
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এ সরকার দ্বায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় নগরীরর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাতে সংস্কার চেয়েছেন ট্রাফিক পুলিশ সংশ্লিষ্টরা।
সেগুলো হলো- ঢাকা মহানগরীর যানযট নিরসনে কাজ করা সরকারি ১২টির মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক ইউনিটের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে যুগোপযোগী ডিএমপি ট্রাফিক আইন ও বিধিমালা করা, ট্রাফিক ইন্টারনেট সেকশন ব্যবস্থাপনা, যানবাহনের আধিক্য ও শ্রেণিকরণ, নিরাপদ পথচারী পারাপারের জন্য এই মুহূর্তে পোর্টবেল সিগন্যাল লাইট, ট্রাফিক সাইন ও ভেরিয়েবেল ম্যাসেজ বোর্ড (ভিএমএস) স্থাপন, এডভান্স ড্রাইভার এসিসটেন্স সিস্টেম (এডিএস) অ্যান্ড ড্রাইভার মনিটরিং সিস্টেম (ডিএমএস) ও ট্রান্সপোর্ট মডিলিং সফটওয়ারের ব্যবহার, ট্রাফিক ক্যানোপি স্থাপনসহ এডাপটিভ ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম, আইটিএস, এআই এবং সাইবার সফটওয়ার সংযোজনের মাধ্যমে সমন্বিত এবং অটোমেটেড ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যাওয়া।
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আতঙ্কিত হয়ে পুলিশ সদস্যরা থানা ছেড়ে চলে যান। এতে ভেঙে পড়ে আইনশৃঙ্খলাসহ বড় শহরগুলোর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় নামেন শিক্ষার্থীরা। গত কয়েকদিন ধরে তারা রাজধানীসহ সারাদেশে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও এ কাজের প্রশংসা করে শিক্ষার্থীদের সনদ দেয়ার কথা বলেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও তাদের এ সহায়তার প্রশংসা করা হচ্ছে। তবে যেখানে দুজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য দিয়ে দায়িত্ব পালন করা হতো সেখানে ঝড়-বৃষ্টি ও রোদে পুড়ে অনেক শিক্ষার্থীকে কাজ করতে দেখা গেছে।
ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহারের অভিযোগে সাধারণ জণগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য জনরোষে পড়ে নিহত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে তারা কাজে ফিরলেও এখনো তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। তবে শৃঙ্খলা ফেরাতে অনেক কিছুর সংস্কারের কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিক ব্যবস্থায়ও সংস্কার চান তারা। তারা বলছেন, ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়
মূলত অপারেশনাল ভূমিকা পালন করে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু ট্রাফিক অবকাঠামো, ট্রাফিক বিভাগের প্রকৌশলগত বিষয়সমূহ, রাস্তায় চলাচলরত সব যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, গণপরিবহন, ফুটপাত, পার্কিং নীতিমালা, রাস্তায় গাড়ির ধারণক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ, বায়ুদূষণ, বাস-বে, বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, সরকারি ডাম্পিং স্টেশন ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আধুনিক অটোমেটেড ট্রাফিক সিগন্যাল ও নিরাপদ পথচারীদের পারাপার, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করিডোর ব্যবস্থাপনাসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার প্রায় সব বিষয় ঢাকা সিটি করপোরেশন, ডিটিসিএ, বিআরটিএ, বিআরটিসি, সেতু বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ব্যবস্থাপনা করে থাকে।
ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থাপনাসহ বিগত বহু বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার নানা প্রকল্প এসব প্রতিষ্ঠান নিলেও ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সফল হতে পারেনি। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগ এখনো হাতের ইশারায় মহানগরবাসীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। অথচ ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে সরকারের ১১-১২টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত তবুও সবাই কেন জানি ট্রাফিক বিভাগের ওপর দায় চাপিয়ে দেয় সবসময়। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ আরো অনেক দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থার অত্যন্ত নিবিড় ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে ট্রাফিক বিভাগের উন্নয়নে ও আধুনিকায়নে বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সেই নিবিড় সম্পর্কটি এখনো গড়ে উঠেনি। তাই ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে যুগোপযোগী ডিএমপি ট্রাফিক আইন ও বিধিমালা জরুরি। এখনি ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক সিস্টেমে যাওয়া সম্ভব না হলেও এখন অন্তত এ সরকার চাইলে এডাপটিভ ট্রাফিক সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে।
তারা আরো বলছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ যে কষ্টের কাজ তা শিক্ষার্থীরাও অনুধাবন করতে পেরেছে ইতোমধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে ডিএমপিতে অতিগুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ মোট ৩৪০টি ট্রাফিক ইন্টার সেকশন রয়েছে। এই ট্রাফিক ইন্টার সেকশনগুলোতে পুলিশ সদস্যদের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান ও বৈরী আবহাওয়ায় কাজ করতে হয়।
এমন পরিস্থিতিতে অন্তন্ত ১৫০টি ইন্টার সেকশনে ট্রাফিক সদস্যদের জন্য রিফ্লেক্টেড ট্রাফিক ক্যানোপি স্থাপনসহ এডাপটিভ ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম ব্যবস্থাপনায় যাওয়া যেতে পারে। পুলিশ সদস্যরা ভালো পরিবেশ পেলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা গতিশীলতা বাড়বে। এছাড়াও ট্রাফিক ইন্টারনেট সেকশন ব্যবস্থাপনা, যানবাহনের আধিক্য ও শ্রেণিকরণ, নিরাপদ পথচারী পারাপারের জন্য এই মুহূর্তে এডাপটিভ ট্রাফিক সিস্টেমের আওতায় পোর্টবেল সিগন্যাল লাইট, ট্রাফিক সাইন ও ভেরিয়েবেল ম্যাসেজ বোর্ড (ভিএমএস) স্থাপন করা গেলে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব।
অন্যদিকে এই মুহূর্তে ঢাকা মহানগরীর রাস্তায় যত ইউটার্ন রয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে নতুনভাবে ডাইভারশন পয়েন্ট ও সময় অনুযায়ী একমুখী ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক সার্কুলেশন পরিকল্পনা যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যেহেতু সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কোনো সমন্বয় ও পরিকল্পনা ছাড়া রোড পার্কিং, রাস্তার মাঝে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমের পিলার স্থাপনসহ নানা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করে থাকে তাই সেটির নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়ের সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতামূলক নীতিমালা যানজট নিরসনের জন্য অবশ্যম্ভাবী।
এদিকে, বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ডিএমপি ট্রাফিক কারিগরি ইউনিটের জন্য মোট ৩৯টি পদ রয়েছে। এসব পদে অতি দ্রুত নিয়োগ দেয়াসহ আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য মোট সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার ট্রাফিক জনবল সংস্থাপন, লজিস্টিক সাপোর্ট, আধুনিক ট্রাফিক কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন জরুরি। ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (ট্রাফিক-অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ) মো. জাহাঙ্গীর আলম ভোরের কাগজকে বলেন, বৈষম্যহীন উন্নত বাংলাদেশ, শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো ও মহানগরবাসীর সেবা যুগোপযোগী করতে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের জন্য এই মুহূর্তে ট্রাফিক নিয়ে গবেষণা আরো উন্নত করা এবং প্রকৌশলগতভাবে ট্রাফিক অবকাঠামো নির্মাণ খুবই জরুরি। এছাড়াও, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের সক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।