ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ উধাও

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভোজ্যতেল
মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পুষ্টি উপাদান ভিটামিন ‘এ’। এর স্বল্পতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটি নীরব মহামারি আকারে ধরা পড়ছে। তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪৩ দশমিক ৭০ শতাংশ শিশু স্বল্পমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ ঘাটতিতে (মাইল্ড ডেফিশিয়েন্সি) ভুগছে। তবে গুরুতর মাত্রার ঘাটতি নেই। ভিটামিন ‘এ’ স্বল্পতায় ভোগা শিশুর মধ্যে মেয়ের তুলনায় ছেলের সংখ্যা বেশি। গবেষণার ফলাফল বলছে, ভিটামিন ‘এ’ র অভাবে মৃত্যুঝুঁকি ২৪ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়া হৃদরোগ, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ে।
বিশ্বজুড়ে খাদ্যে ভিটামিন ‘এ’ সংযোজন একটি কার্যকর ও অর্থসাশ্রয়ী পদক্ষেপ। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের কোনো একটি নির্দিষ্ট খাদ্যে বাধ্যতামূলকভাবে এ ভিটামিন প্রয়োগ করে থাকে। গুয়াতেমালা, চিলি ও যুক্তরাজ্যে ভিটামিন ‘এ’ মেশানো হয় দুধে। ডেনমার্কে মারজারিন নামের খাদ্যে সংযোজন করা হয় ভিটামিন ‘এ’। একইভাবে বলিভিয়ায় ভেজিটেবল অয়েলে যুক্ত করা হয় ভিটামিন ‘এ’। সরকার ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন পাস করে ২০১৩ সালে।
আইন অনুযায়ী, ভিটামিন ‘এ’ না মিশিয়ে কোনো ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণের সুযোগ নেই কোম্পানিগুলোর। তেলে এই ভিটামিনের উপস্থিতি না থাকলে আছে শাস্তির বিধানও। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখনো অনেক ভোজ্যতেল বিপণন হচ্ছে ভিটামিন এ ছাড়াই।
জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বরাত দিয়ে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান ‘প্রজ্ঞা’ র তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ভোজ্যতেলের প্রায় ৭০ শতাংশ পাম তেল, ২০ শতাংশ সয়াবিন এবং ১০ শতাংশ সরিষা, রেসপিড ও অন্যান্য তেল ব্যবহৃত হয়। ৬৫ শতাংশ ভোজ্য তেল ড্রামে এবং ৩৫ শতাংশ বোতল বা প্যাকেটে বিক্রি হয়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ড্রামে বাজারজাত করা ৫৯ শতাংশ ভোজ্যতেলেই নির্ধারিত মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ নেই। এমনকি ভোজ্যতেল সংরক্ষণ বা সরবরাহের ক্ষেত্রে নীল রঙের কেমিক্যালের ড্রাম ব্যবহারে ভোজ্যতেল বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
দেশে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), এফএও এবং ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের মাধ্যমে করা গবেষণা অনুযায়ী ১৫ থেকে ৩০ পিপিএম নির্ধারিত। ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ মেশানো হচ্ছে কিনা তা তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশের বাজার থেকে ৯১৩টি নমুনা সংগ্রহ করে বিএসটিআই পরীক্ষা করে। এরমধ্যে বোতলজাত ৫২০টি এবং ড্রামের ৩৯৩টি নমুনা ছিল। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পায়, ড্রামে বাজারজাত করা তেলের ৫২ দশমিক ৬৭ শতাংশের মধ্যে এবং বোতলজাত ৮৭ শতাংশের মধ্যে ভিটামিন এ রয়েছে। তবে দেশে ভিটামিন এ না মেশানোর কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা অথবা আইনের আওতায় আনতে দেখা যায় না খুব একটা। জানা যায়, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২২ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এই তেলের ৯৫ শতাংশই আমদানি নির্ভর।
আইন ও বিধিমালায় যা আছে : সরকার ২০১৩ সালে ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণ আইন এবং ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন করে। আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, সয়াবিন, পাম অয়েল, পাম অলীন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অন্য যে কোনো উদ্ভিজ্য তেলে নির্ধারিত মাত্রায় ভিটামিন এ মেশানো বাধ্যতামূলক। সমৃদ্ধকরণ প্রতীক ছাড়া এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপকরণ দিয়ে তৈরি প্যাকেট বা পাত্রে ভোজ্যতেল বাজারজাত করা যাবে না। একই সঙ্গে প্রতি গ্রাম তেলে সর্বনি¤œ শূন্য দশমিক শূন্য ১৫ মিলিগ্রাম থেকে শূন্য দশমিক শূন্য ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন এ থাকতে হবে। এই নিয়ম না মানলে কেউ ভোজ্যতেল বিক্রি, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বাজারজাত করতে পারবেন না। সেই সঙ্গে তেলের বোতল, প্যাকেট, টিন বা পাত্রের গায়ে মোড়ক প্রদর্শন করতে হবে।
ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ না থাকার কারণ : জানা যায়, সরকার ২০২২ সালের ১৬ মার্চের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর ননফুড গ্রেডেড ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাত ও পরিবহন বন্ধ করার জন্য নির্দেশ জারি করে। কিন্তু কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং অন্যান্য সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সময়সীমা বাড়ানো হয়। সয়াবিন তেল বাজারজাতকরণের সময়সীমা ২০২২ সালের ৩১ জুলাই এবং খোলা পাম অয়েল বাজারজাত করার সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে আরো ৬ মাসের জন্য সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের ফেব্রয়ারি পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু এখনো অস্বাস্থ্যকর, অনিরাপদ ও ফুডগ্রেডবিহীন ড্রামে ভোজ্য তেল বাজারজাত করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. শামীমুল হক জানান, খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি বন্ধ কবে থেকে কার্যকর হবে সে বিষয়ে খুব শিগগিরই সভা হবে। তখনই সময়সীমা নির্ধারণ করা হবে।
ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া বলেন, ভোজ্যতেল সংরক্ষণ বা সরবরাহের ক্ষেত্রে নীল রঙের কেমিক্যালের ড্রাম ব্যবহার করা হয়। অথচ সরকার এ ধরনের ড্রাম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এই ড্রামে রাখা ভোজ্যতেল বিষাক্ত হয়ে যেতে পারে, মান ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। এছাড়া তাতে আইনে নির্ধারিত লেবেলিং করা থাকে না। ড্রামে রাখা ভোজ্যতেল কার উৎপাদিত তা দেখা ও বোঝা যায় না। এছাড়া স্বচ্ছ প্যাকেজিং এবং সঠিক সংরক্ষণের অভাবে ভোজ্যতেলের অণু পুষ্টি ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে। এজন্য অস্বচ্ছ প্যাকেজিং ব্যবহার করা, আলো থেকে ভোজ্যতেল দূরে রাখা এবং অতিরিক্ত ব্লিচ করে ভোজ্যতেল সাদা না করার মধ্য দিয়ে ভোজ্যতেলের মান অক্ষুণ্ন রাখা যায়। ভোজ্যতেলের মান অক্ষুণ্ন রাখার দায়িত্ব উৎপাদক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সবার।
ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ ভোক্তাই কম দামের খোলা তেলে অভ্যস্ত। তাছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোও বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য তাদের খাদ্যপণ্যে কমদামে খোলা তেল বেশি ব্যবহার করে। ফলে কোম্পানিগুলো বাজারে যে পরিমাণ ভোজ্যতেল সরবরাহ করে তার ৬৫ শতাংশই খোলা। মাত্র ৩৫ শতাংশ বাজারজাত হচ্ছে বোতলজাত আকারে।
মানবদেহে ভিটামিন ‘এ’-এর গুরুত্ব : এ প্রসঙ্গে পুষ্টিবিদ তামান্না শারমিন ভোরের কাগজকে বলেন, দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণে ভিটামিন এ দরকার। ভিটামিন শ্রেণিকরণে প্রথমটিই হচ্ছে ‘এ’। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, অন্ধত্ব রোধ, শরীরের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ভিটামিন ‘এ’। দেহের বাহ্যিক আবরণের কোষ, ত্বক, দাঁত ও অস্থি গঠনের জন্যও এই ভিটামিন প্রয়োজন। এছাড়া ভিটামিন ‘এ’ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও রক্তস্বল্পতা থেকে সুরক্ষা দেয়, বার্ধক্য রোধে সহায়ক। টিউমার ও ক্যান্সার থেকে রক্ষা করে; লিভার ভালো রাখে। নাকের শ্লেষ্মা, ঝিল্লিকেও সুস্থ রাখে। ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ নিশ্চিত করা গেলে দেশের প্রতিটি ঘরে এই পুষ্টি পৌঁছে যাবে।