ইতিহাসের মহাদুর্দিনে হাল ধরেছিলেন যিনি

হারুন হাবীব
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আমি শেখ হাসিনাকে কেবল প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই দেখিনি। তাকে দেখি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতির বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার একজন হিসেবে, যিনি বাংলাদেশকে ছিনতাইকৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়ার মহাসমরে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। পঁচাত্তরের রক্তপাতের পর দুই যুগের ভয়ংকর যে স্বদেশভূমি, তারই বিপরীতে বাঙালির রাষ্ট্রকে আজকের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার যে সাহসী নেতৃত্ব- তার সর্বাধিনায়কের নাম শেখ হাসিনা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি একটি বড় রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি। সে যুদ্ধ কতটা প্রয়োজনীয়, কতটা ঝুঁকিপূর্ণ- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের ইতিহাস রচনায় অবধারিতভাবেই শেখ হাসিনার রাজনীতি মঞ্চে আরোহণের সময়টি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিদেশের মাটিতে প্রায় ৬ বছর নির্বাসন শেষে দেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে।
বঙ্গবন্ধুকন্যার সেই দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে নতুন যুগের সূচনা করে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, যেদিন ঢাকার মাটিতে তিনি পা রাখলেন, সেদিন লাখো মানুষ হৃদয়ের সবটুকু আবেগ দিয়ে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল নতুন স্বপ্ন ও আশায় বুক বেঁধে। সেই বুক বাঁধার প্রেক্ষাপট অজানা নয় কারো। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে তারই কন্যাকে স্বাগত জানাতে ঢাকা বিমানবন্দরে সেদিন জড়ো হয়েছিল সর্বস্তরের লাখো মানুষ; যে মানুষ জাতির পিতার ধমনি বহনকারীকে স্বাগত জানিয়েছে পরিপূর্ণ আবেগ ও ভালোবাসায়, যে মানুষ সেনাপতি শাসন থেকে মুক্তি চেয়েছে, যে মানুষ মনেপ্রাণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছে এবং জাতির পিতার হত্যাকারীদের শাস্তি চেয়েছে।
অতএব শেখ হাসিনার রাজনীতির হাল ধরার মধ্যে বাংলাদেশের নবজাগরণ আছে; কষ্টকর রাতদিন ও অনেক বেদনার পরও বিজয় আছে। স্বাধীনতার মাত্র মাড়ে ৩ বছরের মাথায় বাংলাদেশের স্থপতিকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করে নতুন রাষ্ট্রকে যেভাবে অকেজো করার চেষ্টা হয়েছিল, রাষ্ট্রের ইতিহাসের স্বাভাবিক যাত্রাপথ যেভাবে রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল, যেভাবে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুদের পুনর্বাসিত করা হয়েছিল, বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসার মধ্য দিয়ে সেই বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করেছে। বুকভাঙা কান্নায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে রক্তের চিহ্ন দেখতে হয় শেখ হাসিনাকে।
কিন্তু শোক করার সময় কই তার? সময়ের কশাঘাত বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে তাকে; শোক ও রোদনকে শক্তিতে পরিণত করতে হয়। তিনি তো রোদন করতে আসেননি, এসেছেন বদ্ধ ইতিহাসের দুয়ার খুলে তার জন্মভূমিকে রাহুমুক্ত করতে। অতএব পিতা, মাতা, তিন ভাই ও ভ্রাতৃবধূদের স্মৃতিতে শোক করার সময় কই। জাতির এক মহাদুর্দিনে স্বদেশের হাল ধরেছিলেন ইতিহাসের আশীর্বাদ বহনকারী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধুর অভাবিত হত্যাকাণ্ডের পর ঘন যে তমসা গ্রাস করেছিল, সেই তমসা তাড়াতে আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন তিনি। সে মশাল, প্রাথমিক সংকট- সীমাবদ্ধতার পর, দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহু মুক্তির পালা।
সব আবর্জনা দূর করতে নববর্ষের প্রভাতে যেমন বাঙালি একাকার হয়, প্রতিশ্রুতিতে সমৃদ্ধ হয়, তেমনি এক শুভ প্রতিশ্রুতির বাতাস বইতে দেখি তার দেশে ফেরার দিন থেকে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর পর দীর্ঘ দুই যুগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে বাংলাদেশ রাষ্ট্র শাসিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ইতিহাস বিরোধীদের হাতে। জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারগুলো দেশকে সাম্প্রদায়িক বানিয়েছে নিত্যনতুন পরিকল্পনায়, যাতে ’৭১ ছাপিয়ে ’৪৭ ফিরে আসে। সরকার, প্রশাসন ও সেনাবাহিনীতে একাত্তরের চেতনাবিরোধীদের জায়গা দিয়ে এমন এক প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল, যা ভাঙা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কাজেই রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনাকে ভয়ংকর ঝুঁকি নিতে হয়েছে।
ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করতে হয়েছে। বিপদসংকুল পথে এগিয়ে যাওয়ার এই যে সাহস, এই যে দৃঢ়তা- তার সবটাই দেখাতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধুর এই জ্যেষ্ঠ কন্যা। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে তিনি তার অভীষ্ট দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন; ঘাতকদের বারংবারের আক্রমণেও পিছিয়ে আসেননি, পথভ্রষ্ট হননি; হলে লুণ্ঠিত গৌরব ফিরে পাওয়া সহজ হতো না বাংলাদেশের। তিন যুগেরও বেশি সময় পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়াটি ছিল বিশ্ব মানদণ্ডে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত, যা শুরু ও সম্পন্ন করে জাতিকে এক বড় কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তারই সাহসী ও দৃঢ়প্রত্যয়ী রাজনৈতিক নেতৃত্বে ইতিহাসের ঘৃণ্য ঘাতকেরা শাস্তি লাভ করেছে, কৃত অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছে, যা সাধারণ কোনো কাজ ছিল না।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী তস্করদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি তিনি কেবল শুরুই করেননি, প্রবল সাহস ও বিচক্ষণতায়, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে, এগিয়ে নিয়েছেন। এই দুটি কাজ, যা এককালে অভাবিত ভাবা হয়েছে, বাঙালি জাতিকে সভ্য জাতিতে পরিণত করেছে, বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। অনেক অর্জন ঘটেছে বাংলাদেশের, কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজো এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। দুর্ভাগ্য এতটাই যে, রাষ্ট্রবিরোধীরা আজো জয় লাভ করার স্বপ্ন দেখে! কাজেই আত্মতুষ্টির সুযোগ কই? সে কারণেই বলি, প্রতিপক্ষের একাধিক আক্রমণ পরাস্থ করার পরও দীর্ঘস্থায়ী সমরে জেতার প্রস্তুতি চাই। চাই আদর্শিক যোদ্ধা তৈরি করার কৃতিত্ব। ভুলে গেলে চলবে না যে, অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শত্রæরা প্রাথমিকভাবে পরাজিত হলেও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেমেছে তারা।
অতএব আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। এবং সে কারণেই রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নেয়ারও বিকল্প নেই। বাঙালি জীবনের নতুন এক নবজাগৃতি চাই; যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চর্চার আরাধ্য কাজ। আমার বড় দুঃখ হয় যখন দেখি- আদর্শিক রাজনীতির ক্রমান্বয় পতন ঘটছে; রাজনীতি কেবলই স্লোগান সর্বস্ব হয়ে উঠছে; যা সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয় বটে, কিন্তু বৃহৎ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নয়। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে জনপ্রত্যাশা অপরিসীম। প্রত্যাশার এই সীমা এতটাই যে বেশির ভাগই যেন ভুলতে বসেন কী ভয়ংকর কূট পরিকল্পনা ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মকে ব্যর্থ করা চেষ্টা হয়েছিল পঁচাত্তর পরবর্তীকালে!
কিন্তু শেখ হাসিনা ব্যর্থ হননি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশকে তিনি নতুন জীবন দান করেছেন। প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের লুণ্ঠিত ধারাকে ফিরিয়ে এনেছেন। ইতিহাসের এক মহাদুর্দিনে বিপন্ন স্বদেশের হাল ধরেছিলেন ইতিহাসের আশীর্বাদ বহনকারী শেখ হাসিনা। এ যেন বঙ্গবন্ধুর রক্তের ফিরে আসা, প্রবল বিক্রমে। পঁচাত্তর পরবর্তী ঘন যে তমসা, সেই তমসা তাড়াতে আলোর মশাল জ্বালিয়েছেন তিনি। সে মশাল, সংকট-সীমাবদ্ধতার পরও, দিকে দিকে আলোকিত করতে থাকে, শুরু হয় রাহু মুক্তির পালা। রাজনীতিতে তার অধিষ্ঠানের দিনটিকে, সে কারণে, জাতীয় নব জাগৃতির দিন বলতে দ্বিধা নেই আমার। সব আবর্জনা দূর করতে নববর্ষের প্রভাতে যেমন বাঙালি একাকার হয়, নব প্রতিশ্রুতিতে সমৃদ্ধ হয়, তেমনি এক শুভ প্রতিশ্রুতির বাতাস বইতে দেখি তার আগমনে।
বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচকে এগিয়ে। অনস্বীকার্য, কোনো সরকারের কার্যক্রমই সমালোচনা কিংবা সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। সে অর্থে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে সরকারবিরোধীদের স্বাধীন ও উন্মুক্ত কার্যক্রম জরুরি। বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে জনপ্রত্যাশার সীমা এতটাই ব্যাপক যে সবাই যেন ভুলতে বসেন কী ভয়ংকর কূট পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্মকে ব্যর্থ করা চেষ্টা হয়েছিল পঁচাত্তর পরবর্তীকালে! কিন্তু শেখ হাসিনা ব্যর্থ হননি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাংলাদেশকে তিনি নতুন জীবন দান করেছেন। প্রবল প্রতিকূলতা মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের লুণ্ঠিত ধারাকে ফিরিয়ে এনেছেন।
এরপরও বলি, রাজনৈতিক জীবনের অনেক কঠিনতম সময় পাড় করেও বাধার সব প্রাচীর পেরোতে পেরেছেন তিনি- তা বলা যাবে না। সব বিবেচনায় রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি এগিয়ে নিতে হবে সাংস্কৃতির যুদ্ধ, সূচনা করতে হবে সাংস্কৃতিক জাগৃতি, রেনেসাঁ; যা মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার আদর্শে আমাদের জাগিয়ে দেবে। ভয় হয় যখন মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তি গতানুগতিক হবার শঙ্কা তৈরি করে, নিজেদের অধিকতর যোগ্য করে তোলার প্রয়োজন বোধ করে না এবং আত্মতুষ্ট হয়। এই তফাৎ বড় বেশি প্রয়োজন, তা নাহলে আগামীর সময় ভালো ও মন্দের তফাৎ গুলিয়ে ফেলবে- যা হবে বড় ব্যর্থতা ও বিপর্যয়। অতএব প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের আদর্শিক সৈনিকের- কেবল ক্ষমতার সৈনিক নয়। মনে রাখা উচিত যে, জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু কেবল কণ্ঠে ধারণ করার স্লোগান নয়, একে ধারণ করতে হবে আত্মায় ও হৃদয়ে; এ না হলে বাংলাদেশ অরক্ষিত হবে, ভালো-মন্দ, শুভ ও অশুভ একাকার হবে; যা হবে জাতীয় বিপর্যয়। হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।