ঢাকার নাগরিকসেবা তলানিতে

মুহাম্মদ রুহুল আমিন
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বর্তমানে ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২৯টি; এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৫৪ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৭৫টি। এসব ওয়ার্ড নিয়ে দুই সিটিতে অঞ্চল আছে ২০টি। নাগরিক সেবা সহজ করতে ২০১১ সালে সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে। মেয়র ও কাউন্সিলরের মাধ্যমে পরিচালিত হতো সিটি করপোরেশন দুটি। ফলে কোনো প্রকার ভোগান্তি ছাড়াই নাগরিত সেবা পেতেন ঢাকার বাসিন্দারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিসহ দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করে সরকার।
১ অক্টোবর থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলদের কার্যালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ২০টি অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের। আর তখন থেকেই জন্ম-মৃত্যু সনদসহ যে কোনো সেবা পেতে চরম ভোগান্তি শুরু হয় নগরবাসীর। সেবাপ্রার্থীরা হয় সনদ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকছেন, অথবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। এছাড়া নিজ নিজ এলাকায় নাগরিক সেবা নিয়ে অসন্তোষ ও ভোগান্তি ক্রমেই বাড়ছে। পাশাপাশি সড়ক, ড্রেনেজ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ট্রাফিক সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নাগরিকদের অভিযোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে সাধারণত নাগরিকদের জন্ম ও মৃত্যুসনদ দেয়া হয়। এছাড়া নাগরিক, চারিত্রিক, ওয়ারিশ সনদ, আয়, অবিবাহিত, দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ না হওয়া, পারিবারিক সদস্য, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতার সত্যায়িত সনদও দেয়া হয় এই দপ্তর থেকে। বিভিন্ন প্রত্যয়ন, অনাপত্তিপত্র (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার তালিকায় যাচাইকারী হিসেবে স্বাক্ষর দিতে হয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
কিন্তু তাদের পদচ্যুতির পর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস থেকে জন্ম ও মৃত্যুসনদ দেয়া হয়। দুই সিটিতে ১০টি করে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস রয়েছে। দক্ষিণ সিটির ৭৫ জন কাউন্সিলর যে কাজ করতেন, সেটি মাত্র ১০ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে দিয়ে করা কঠিন। একইভাবে উত্তর সিটিতেও ৫৪ জনের কাজ ১০ জন নির্বাহী কর্মকর্তাকে করতে হচ্ছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে সচিব থাকার কথা থাকলেও সব ওয়ার্ডে তা নেই।
আর সচিবদের ওয়ার্ডের অফিস স্থানান্তর হওয়ায় নাগরিকদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। দুই সিটিতে মেয়রের পরিবর্তে এখন সরকারী কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রশাসক বসানো হয়েছে। তারা করছেন মেয়রের কাজ। ঢাকায় প্রায় দুই কোটির বেশি মানুষের বসবাস। এত মানুষের নাগরিক সেবা এসে পড়েছে ২ জন প্রশাসক আর ২০ জন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার ওপর। ফলে তারাও কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারছেন না নগরবাসীকে।
ছেলের পাসপোর্ট করাবেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তানভীর ইসলাম। এ কাজে তার দরকার নাগরিক সনদ। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে গিয়ে জানতে পারেন, সেখান থেকে এখন কোনো নাগরিক সনদ দেয়া হয় না। কারণ কাউন্সিলরও নেই, ওয়ার্ড সচিবও নেই। ওয়ার্ড সচিব বসেন খিলগাঁও রেলগেট সংলগ্ন বাসাবো কমিউনিটি সেন্টারে। স্থানীয়রা তানভীরকে যেতে বলেন সেখানে। তিনি যান বাসাবো কমিউনিটি সেন্টারে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল করেন তিনি।
ওয়ার্ড সচিব কাগজ জমা নিয়ে তিন দিন পর আসতে বলেন তানভীরকে। কারণ হিসেবে তাকে জানানো হয়েছে, এই কাগজ পাঠানো হবে অঞ্চল-২ এর আঞ্চলিক অফিসে। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা স্বাক্ষর করবেন, এরপর তাকে দেয়া হবে। কিন্তু তার আগেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পর্কে তথ্য জানতে তাকে একাধিকবার ওয়ার্ড সচিব কার্যালয়ে যেতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
এই প্রতিবেদককে তানভীর জানান, যখন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিল, তখন খুব সহজেই নাগরিক সনদ পাওয়া যেত। কোনো দেরি করতে হতো না। আর এখন নাগরিক সনদের জন্য অনেক কাগজ জমা দিতে হয়, তারপরও ভোগান্তি। সেটার জন্য আবার যেতে হয় প্রথমে ওয়ার্ড সচিবের কাছে। সেখানে কাগজ জমা দেয়ার পর আবার ৩ থেকে ৪ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এভাবে অনেকেই বিরক্ত ও ত্যক্ত হয়ে যান।
জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণের ১ থেকে ১৩ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ২ নম্বর অঞ্চল গঠিত। এটি খিলগাঁও তিলপাপাড়ায় অবস্থিত। সেক্ষেত্রে খিলগাঁও, সবুজবাগ, মুগদা, মান্ডা, মানিকনগর, গোপীবাগ, মতিঝিল, আরামবাগ, পল্টন, ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর, শান্তিনগর, মালিবাগ, শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দাদের যেকোনো সেবা পেতে এখানে আসতে হয়। অথচ পল্টন ও মতিঝিলের খুব কাছাকাছি নগর ভবনের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত।
রাজধানীর সিদ্বেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা সজল মাহমুদ ছেলেকে ভর্তির জন্য জন্মসনদ করাবেন। এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। এটি ১ নম্বর অঞ্চলে অবস্থিত, যার প্রধান কার্যালয় নগরভবনে। আগে ইস্কাটনে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসে গেলেই পাওয়া যেতো, এখন ভোগান্তির কথা শুনে তিনি অনেকটাই হতাশ। নানাজনের কাছে তথ্য জেনে জন্ম সনদ করতে যেসব কাগজ দরকার, সেগুলো জোগার করবেন তিনি। এরপর নগর ভবনে কাগজ জমা দেবেন। তবে তার মধ্যে হয়রানির শঙ্কা কাজ করছে।
ছেলেকে স্কুলে নিয়ে এসেছেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা রফিকুল আজাদ। থাকেন প্রবাসে। ৫ মাসের জন্য ঢাকায় এসেছেন। এই অল্পসময়ে ঢাকার পরিবেশ নিয়ে খুবই বিরক্ত ও ত্যক্ত তিনি। ঢাকার সেবা কর্মকান্ড নিয়ে গতকাল শহীদ বাবুল একাডেমি খিলগাঁও শাখায় সন্তানের স্কুলের সামনে তাকে ব্যাপক ক্ষোভ ও আক্ষেপ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তার সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ঢাকার যানজট, ভাঙাচোরা রাস্তা ও বর্জ্য অপব্যস্থাপনা নিয়ে। তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো শহরে এত অশান্তি নেই। যত্রতত্র ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ধুলোবালি এবং ময়লা-আবর্জনা যেখানে সেখানে পড়ে আছে। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। এই নগরীতে কেউ কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা মানছেন না। তার প্রশ্ন, ঢাকায় কি এসব দেখার কোনো কর্তৃপক্ষ নেই?
নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সিটি করপোরেশন ও ওয়ার্ডগুলোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেবা পেতে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে- এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একেবারেই উদাসীন। সিটি করপোরেশনে যাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা অফিসে সবসময় নিয়মিত নন। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরাই তো এক ধরনের সিলেকটেড। সেই অর্থে তারা সব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারবে না- এটাই স্বাভাবিক।
বর্তমানে জনপ্রতিনিধি না থাকায় অনেক সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে আদিল খান বলেন, অনেক এলাকায় দখলগুলো ফেরত আসছে। জনপ্রতিনিধি নেই বলে সেগুলো রক্ষা করা যাচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা প্রচুর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করছি। এখন তো মেয়র আর ওয়ার্ড কাউন্সিলররা দায়িত্বে নেই। তাদের অনুপস্থিতিতেও সেখানে কেউ নেই। স্থায়ী জনবলের ক্ষেত্রেও অঞ্চল ও ওয়ার্ডভিত্তিক অনেক পদ শূন্য আছে। এ অবস্থায় আগের মতো সব সেবা শতভাগ সুন্দরভাবে দিতে পারব, এমনটাও আমরা প্রত্যাশা করছি না। তবে আমাদের আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশান ও নাগরিকত্বসহ অন্যান্য সনদ আমরা দিচ্ছি। এক্ষেত্রে নভেম্বর-ডিসেম্বরে একটু চাপ বেশি ছিল; কারণ জানুয়ারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির বিষয় থাকে। আমাদেরও সীমাবদ্ধতা ছিল। তবে জানুয়ারি মাসে এসে কিছুটা উন্নতি করেছে। ধীরে ধীরে আরো উন্নতি করতে পারব।
তিনি বলেন, জনবল ঘাটতি পূরণে আমরা চেষ্টা করছি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করেছি। যদিও বিষয়য়টি একটু সময়ের ব্যাপার। তাছাড়া যেসব পদ ডেপুটেশনে পূরণ করা যায়, সেগুলোও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে আমরা করব। তবে এ বিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব বশিরুল হক ভুঁঞার ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।