থার্টি ফার্স্ট ঘিরে নকল, ভেজাল মদের ছড়াছড়ি

কামরুজ্জামান খান
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের জন্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এখন মদ-বিয়ারের ছড়াছড়ি। বিদেশি মদের সঙ্গে বেড়েছে নকল ও ভেজাল মদের বিকিকিনি। হাত বাড়ালেই মিলছে বিদেশি সব ব্রান্ডের নকল মদ। বিষাক্ত মদপানে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। রাজধানীজুড়ে বাইসাইকেল ও মোটর সাইকেলযোগে হাতে হাতে পৌঁছে দেয়া মদের প্রায় সবই নকল ও ভেজাল।
চীন ও ভারত থেকেও নানা পন্থায় আনা মদেও রয়েছে ভেজাল। মূলত ৬৩৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে মদ আমদানি করায় বৈধপন্থায় বারগুলোতে বিক্রি করা মদের দাম অনেক। এ অবস্থায় কমদামে বিদেশি ব্রান্ডের মদ পাওয়া না যাওয়ায় সহজলভ্য হওয়ায় অল্প টাকায় নকল ও ভেজাল মদের দিকে ঝুঁকছে অনেকে। আবার থার্টি ফার্স্ট উদযাপনে সরকারি বিধিনিষেধ থাকলেও অধিকাংশ বার ও ক্লাব এর তোয়াক্কা করছে না।
থার্টি ফার্স্ট নাইটে কৌশলে আয়োজন রেখেছে পার্টির। প্রতিটি বারের পেছনের জরুরি বহিরগমন সিঁড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে। উত্তরা, গুলশান, বনানী এলাকার একাধিক বারে এই আয়োজন রয়েছে। খিলক্ষেত এলাকার একটি অভিজাত হোটেল সেলিব্রেশন পার্টির নামে টিকেট বিক্রি করছে কয়েক হাজার টাকায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইশৃঙ্খলা বাহিনী চুপ থাকার সুযোগে অনেক ক্লাব, বার ও রেস্টুরেন্টে রাত্রিকালীন আয়োজনে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার শঙ্কা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, থার্টি ফার্স্ট নাইটে সব বার বন্ধ থাকবে। এজন্য কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের অ্যাসোসিয়েশনও এ ব্যাপারে নোটিস দিয়েছে। এর মধ্যেও যদি কোনো বার, রেস্টুরেন্ট বা ক্লাব খোলা রেখে মদ বিক্রি বা পরিবেশন করে তা ধরতে একাধিক মোবাইল টিম গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, নকল ও ভেজাল মদ বিক্রি ঠেকাতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সব ইউনিটকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেজর (অব.) এম জাহাঙ্গীর হোসেইন বলেছেন, বৈধভাবে ভেজাল মদ বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। এর সঙ্গে কোনো বারের সম্পর্ক নেই। পর্যটন করপোরেশন বিদেশ থেকে মদ আমদানি করে থাকে। দেশে তৈরি ক্রাউন বেভারেজের হান্টার এবং কেরুর মদ বিক্রি হয় বারে। তিনি বলেন, বিভিন্ন জেলায় ভেজাল ও নকল মদপানে মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই চক্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করলে মানুষ উপকৃত হবে।
জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩৭টি বারের অনুমোদন রয়েছে। তার মধ্যে হোটেল বার ১২৩টি, রেস্টুরেন্টে ৬২, ক্লাবে ৪৮ এবং রিসোর্টে চারটি বার রয়েছে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ আবাসিক হোটেল লিমিটেডের অনুকূলে ১৯৫৯ সালে দেশে প্রথমবারের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫৬ বছরে বার খোলার অনুমোদন পেয়েছে ৮৮ প্রতিষ্ঠান। বাকি ৮৯টি প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়েছে গত আট বছরে। ২০১৯ সালে ৩০টি বার অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৮ সালে ৯টি, ২০২০ সালে ৮টি, ২০২১ সালে ৩টি, ২০২২ সালে ২০টি, ২০২৩ সালে ২০টি এবং চলতি বছর চারটি বারের অনুমোদন হয়েছে। প্রিমিয়ার হোটেল কোম্পানির অধীনে গুলশানের রেনেসাঁ হোটেলকে দেয়া হয়েছে সাতটি বারের অনুমোদন। গত আট বছরে ৮৯ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় দেড়শ বারের অনুমোদন হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার ওনার্স এসোসিয়েশন থার্টি ফার্স্ট নাইট বা ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের দিনে সদস্য বৈধ বারগুলোর জন্য নির্দেশনা জারি করেছে। তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যেসব নির্দেশনা দেবেন তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করতে বলা হয়েছে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে বৈধ বারে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে বার প্রিমিজেসে কোনো প্রকার ডি জে পার্টি আয়োজন করা যাবে না। কোনো অননুমোদিত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক অতিথি প্রবেশ করতে দেয়া বা সেবা দেয়া যাবে না। বার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বন্ধ করতে হবে। কোনো অননুমোদিত ব্যক্তির কাছে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় বিক্রি করা যাবে না। নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী দ্বারা নিñিদ্র নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট আইন অধিদপ্তরকে ও অত্র সংগঠনকে তাৎক্ষণিক জানাতে হবে। তবে সব বার অ্যাসোসিয়শেনের সদস্যভুক্ত নয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দেশে ভেজাল ও নকল মদপানে মৃতদের দেহ ময়নাতদন্তে মিথানল বিষক্রিয়ার নমুনা পাওয়া গেছে। মিথানল বা মিথাইল অ্যালকোহল হচ্ছে স্পিরিটের সবচেয়ে অশোধিত পর্যায়। সাধারণত এটি হালকা, বর্ণহীন এবং উগ্র গন্ধযুক্ত হয়। কাঠের বা প্লাস্টিকের কাজ, বার্নিশ বা রং করা অথবা ছাপাখানার কাজ- এরকম বহু ক্ষেত্রে মিথানল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অবৈধভাবে মদ উৎপাদনকারীরা ইথানলের সঙ্গে মিথানলের মিশ্রণ করে এক বোতল মদ দিয়ে ১০ বা ২০ বোতল মদ তৈরি করছে। রং, ফ্লেভার মিশিয়ে বিদেশি বোতলে ভেজাল মদ ভর্তি করা হচ্ছে। বিদেশি মদ বলে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেকে এসব মদ খেয়ে মারা যাচ্ছেন। কেউ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আইনি প্রক্রিয়ায় মদ আনতে গেলে ৩০০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। ব্যবসায়ীরা এ ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করেন। এই মদ খেলে অন্ধ হয়ে যাওয়া, কিডনি বিকল হওয়া ও হার্টঅ্যাটাকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে।
একাধিক বার মালিক জানিয়েছেন, সাধারণত সরকার অনুমোদিত কিছু ওয়্যার হাউস, লাইসেন্সকৃত পানশালা এবং বিভিন্ন হোটেল থেকে মদ কিনে থাকেন মানুষ। শুধু মদ সেবন করার লাইসেন্সধারী ব্যক্তিরাই এসব জায়গা থেকে মদ কিনতে পারবেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাঝে মধ্য বিভিন্ন ক্লাব ও পানশালায় অভিযান চালিয়ে মদ বাজেয়াপ্ত করে থাকে। তবে আইনের কড়াকড়ি থাকায় ক্রেতাদের একটা বড় অংশ মদ কিনে থাকেন অবৈধ বিক্রেতাদের কাছ থেকে। আর ক্রেতাদের এই চাহিদার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভেজাল মদ তৈরি ও বিক্রি করেন এক শ্রেণির বিক্রেতা।