আস্থার ফাটল মেরামতের বার্তা
তিন মাস আগে থেকে তৈরি হওয়া সংকট কাটাতে পথ খুঁজল দুই দেশই

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চরমপন্থি বক্তৃতা বেড়ে যাওয়া, সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ঘটনা ও উসকানি- বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তলানিতে থাকা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আস্থায় টানতে বৈঠকে বসল বাংলাদেশ ও ভারত। এর মাধ্যমে গত তিন মাস আগে থেকে তৈরি হওয়া সংকট কাটাতে পথ খুঁজল দুই দেশই; যা দৃশ্যমান হলো সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির প্রায় সাড়ে ১৩ ঘন্টার ঢাকা সফরে। এই সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন। প্রসঙ্গত, ঢাকায় থাকাকালীন বিক্রমের হাতে কালো রংয়ের একটি ফাইল ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সেই ফাইলের মধ্যেই তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা নিয়ে এসেছেন, যা পরপর তিনটি বৈঠকে উপস্থাপন করে দিল্লি ফিরে গেছেন বিক্রম মিশ্রি।
এর আগে সোমবার (৯ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে মিশ্রির বিমান। তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ এশিয়া) ইশরাত জাহান। এরপর বেলা ১১টার কিছু পর রাষ্ট্রীয় অতিথি নিবাস পদ্মা ভবনে এফওসির প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকের আগে দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব একান্তে বৈঠক সারেন। পরে শুরু হয় এফওসির বৈঠক। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে চলে বৈঠক। বৈঠকের পর বাংলাদেশ দাবি করে বলেছে, দুদেশের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে; তবে কেমন বৈঠক হয়েছে- সে বিষয়ে ভারতের তরফ থেকে কিছু বলা হয়নি। সচিব পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার পর মধ্যাহ্নভোজ শেষে মিশ্রি বিকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মুহাম্মদ তৌহিদ হোসেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে দিল্লি ফিরে যান বিক্রম মিশ্রি।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তারপর এই প্রথম দিল্লি এবং ঢাকার মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে বৈঠক হল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো, তা নিয়ে কৌতুহল রয়েছে দুদেশেই। আগামী দিনে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন চাইছে বাংলাদেশ? যদিও বাংলাদেশের তরফ থেকে আগেই একটি আভাস দেয়া হয়েছিল। গতকাল বৈঠকের পর সেই আভাস মোতাবেক ঢাকা এবং নয়াদিল্লির মধ্যে কূটনৈতিক দূরত্ব কমে কিনা, তাই এখন দেখার। তাদের মতে, গতকাল দিনভর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের হওয়া তিন বৈঠকে আশাব্যঞ্জক খুব একটা কিছু হয়নি। কারণ, বৈঠক শেষে দুতরফেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু তথা হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করে। অপরদিকে, সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে- এমন কথা মানতেই নারাজ বাংলাদেশ। বরং ভারত যাতে এ বিষয়ে কথা না বলে সে বিষয়ে জানানো হয়েছে। এজন্য কূটনৈতিক স্তরে যত বৈঠকই হোক না কেন, মূলত দুই দেশের নানা স্তরে তৈরি হওয়া আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে ফাটলের কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবু হাল ছাড়ছে না দুদেশই।
আরো পড়ুন: জুলাই বিপ্লবগাথা নিয়ে ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি বই
ভারতীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, সোমবারই মাত্র ঢাকায় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হলো। এই বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশ কিছু বার্তা দেয়া হয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশও তাদের কথা তুলে ধরেছে। এর ফলে তৈরি হওয়া পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এই বৈঠকের পরও যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তাহলে রাজনৈতিক পর্যায়ে কূটনীতি মজবুত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। এজন্য ভারতের কোনো সিনিয়র রজনীতিবিদ ঢাকা সফর করতে পারেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে এবং জোরদার করতে আগ্রহী ভারত। একই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে কালো মেঘ জমেছে সেটিও দূর করতে চান তারা। আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের একটা ঘাটতি আছে। এটা যদি স্বীকার না করি তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব না। তিনি বলেন, বিশ্বাসের ঘাটতি ছিল বলেই আমাদের এ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজকের যে বৈঠক সেটি হচ্ছে ঘাটতি মেটানোর পথে এগিয়ে যাওয়ার একটা পদক্ষেপ। এখানে রাজনৈতিক বার্তা যদি দেখেন, তাহলে পরবর্তীস্তরে যাতে আলোচনা হয়, সেটি আমরা আশা করব।
সম্পর্কে মেঘ এসেছে, এটি দূর করতে হবে : ঢাকা সফরে এসে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে দুদেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি মেঘ এসেছে, সেই মেঘটি দূর করতে হবে। বাংলাদেশও বলেছে, এটি দূর করতে হবে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি গতকাল সোমবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর যমুনার সামনে আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্য এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, অপপ্রচারের জবাব লিখিত ও মৌখিক বহুভাবেই বলেছি, যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেগুলোকে সাম্প্রদায়িক দেখানোর সুযোগ খুবই কম। সেগুলো কখনো কখনো ব্যক্তিগত, বেশির ভাগই রাজনৈতিক। আমাদের স্পষ্ট অবস্থান হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার না এটির অংশ, না এটি কোনোভাবেই বরদাশত করছে। যেখানে যেখানে এ রকম অভিযোগ এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সচিবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটি মেঘ এসেছে, এই মেঘটি দূর করতে হবে। আমরাও বলেছি, এই মেঘটি দূর করতে হবে। রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে যে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে সে বিষয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অপপ্রচারের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে যে অপপ্রচার হচ্ছে সে বিষয়ে ভারত সরকার দায়ী নয়। এটি বিভিন্ন সংগঠনের কাজ। তিনি বলেন, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে বসে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য ও বিবৃতির বিষয়েও সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে এবং জোরদার করতে ভারত ইচ্ছা পোষণ করেছে বলেও জানিয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জুলাই-আগস্টে যে বিপ্লব হয়েছে সেটি সম্পর্কে ভারত অবগত রয়েছে। ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান ও বিভিন্ন সময় দেয়া বক্তব্য বাংলাদেশ পছন্দ করছে না, এমন বার্তা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করে যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটা সরকার পছন্দ করছে না বলে জানানো হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে। উত্তরে বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার অবস্থান দুদেশের সম্পর্কে বাধা হওয়া উচিত নয়। এছাড়া বৈঠকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দুদেশকে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ভারতীয় ভিসা দেয়া অনেক কমিয়ে রাখা হয়েছে যার ফলে অনেক অসুবিধা হচ্ছে। এ বিষয়টিও ভারতকে বলা হয়েছে। বিপরীতে তাদের পক্ষ থেকে আমাদের প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে তারা শিগগিরই ভিসা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপতথ্য প্রতিরোধে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা চাইলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন। নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি, নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। এ ব্যাপারে সবাইকে আমাদের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছি।
আগের মতোই সুসম্পর্ক চাই, দিল্লির বার্তায় সংখ্যালঘু-সুরক্ষাও : অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আগের মতোই সুসম্পর্ক চায় ভারত। ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে নয়াদিল্লির এই অবস্থানের কথা স্পষ্ট করলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। একই সঙ্গে বৈঠকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার কথাও জানান তিনি। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সময় বিক্রম মিশ্রি বলেন, আমাদের মধ্যে অত্যন্ত খোলামেলা, গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং উভয়ের পক্ষে লাভজনক সম্পর্ক চায় ভারত। অতীতের মতোই বর্তমানেও নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় বলে জানান তিনি। বৈঠকে কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা বিদ্যুৎ, শক্তি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া, কূটনৈতিক বোঝাপড়াসহ একাধিক বিষয়ে কথা বলেছি। একই সঙ্গে মিশ্রি বলেন, আমরা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়েও আলোচনা করেছি এবং আমি সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা এবং উন্নয়ন নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। আলোচনায় এসেছে সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সম্পত্তি এবং কূটনৈতিক সম্পত্তির উপরে হামলার ঘটনাও। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশে যে একাধিক ‘বদল’ হয়েছে, সে কথাও জানান মিশ্রি। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ভারতের মনোভাব ব্যক্ত করে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেয়ার পর প্রথম যে রাষ্ট্রপ্রধানরা অভিনন্দন জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের মধ্যে অন্যতম। বিক্রম মিশ্রি বলেন, গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। এর সূত্র ধরেই আজকের বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আমার বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, জসীম উদ্দিনের আমন্ত্রণে আমি ঢাকায় এসেছি। বিক্রম মিশ্রি আরো বলেন, নতুন সরকারের সঙ্গে এটা প্রথম ফরেন সচিব মিটিং। আজকের এই আলোচনা আমাদের উভয়পক্ষকে এই সুযোগটা করে দিয়েছে। আমাদের মধ্যে খোলামেলা এবং গঠনমূলক মতবিনিময় হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উভয় দেশের মানুষকেন্দ্রিক হবে জানিয়ে মিশ্রি বলেন, এই সম্পর্ক হবে মানুষকেন্দ্রিক। এটা উভয় দেশের জনগণের উপকারে আসবে এবং এর প্রতিফলন আমাদের প্রাত্যহিক ঘটনার মধ্যে পাচ্ছি।
আরো পড়ুন: ঋণ খেলাপিদের ছাড় নয়, টাকা ফেরাতে আসছে ‘অসংখ্য’ পদক্ষেপ
হাসিনার বক্তব্যে অসন্তুষ্ট বাংলাদেশ, বার্তা পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ : ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্য পছন্দ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার। এই বার্তা পৌঁছে দিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফরেন অফিস কনসালটেশন বা এফওসি বৈঠকের পর এ ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনাকে ফেরানো প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে অবস্থান করে যে বক্তব্য রাখছেন এই বক্তব্যের প্রতি আমরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আপনারা গতকাল শুনেছেন, তিনি (শেখ হাসিনা) একটি বক্তৃতা দিয়েছেন, এটা এই সরকার পছন্দ করছেন না। তারা (ভারত) বলেছেন, হাসিনার উপস্থিতি দুদেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, আমরা বলেছি, তিনি (শেখ হাসিনা) ভারতে বসে যে বক্তব্য দিচ্ছেন সেটা আমাদের পছন্দ হচ্ছে না। তাদের (ভারতকে) আমরা বলেছি, আমরা যে এটা পছন্দ করছি না এটা তাকে (শেখ হাসিনাকে) যেন জানানো হয়। তারা (বিক্রম মিশ্রি) নোট নিয়েছেন। জসীম উদ্দিন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ফেরানোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে অনুরোধ আসার ব্যাপার আছে। আর এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্ত যখন হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন ব্যবস্থা নেবে। এটা এফওসিতে কেন, যে কোনো পর্যায়ে হতে পারে। সেটা কূটনৈতিক পত্রের মাধ্যমেও হতে পারে। দিল্লিতে আমাদের যে মিশন আছে তার মাধ্যমেও জানানো যায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের মন্তব্য ‘সমীচীন’ নয় : ঢাকা সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে গতকাল সোমবার বিভিন্ন বৈঠকের বিষয় তুলে ধরতে ব্রিফিংয়ে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, আমরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও তাদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার বিষয়টি অভ্যন্তরীণ হিসেবে তুলে ধরে এ নিয়ে অন্য দেশের মন্তব্য ‘সমীচিন নয়’ বলে জানিয়েছি। দুদেশের আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের ভূমিকার প্রত্যাশা করার কথাও বলেন তিনি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশে সবাই স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করে আসছে তুলে ধরে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এ বিষয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের সুযোগ নেই। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অপপ্রচার চলার মধ্যে সরকার বাস্তব অবস্থা দেখতে ও পর্যবেক্ষণে বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরের আহ্বান জানিয়েছে বলেও তুলে ধরেন তিনি। জসীম উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব এবং বিপ্লবপরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর বয়ান রয়েছে, সে বিষয়ে আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছি। সেই সঙ্গে আমরা এও বলেছি, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচিন নয়। আমি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকে এবং অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিত। এ সময় সচিব পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুদেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামনে আলোচনা হয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমরা বলেছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের কাছে আমরা আমাদের দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান সব অনিষ্পন্ন বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য ভারতের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করি। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমি দুদেশের সাধারণ জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দেই এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা আশা করি।