×

প্রথম পাতা

হাজার কোটি টাকার সম্পদে সিন্ডিকেটের বদনজর

সরকারিকরণের সুপারিশ উপেক্ষিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাজার কোটি টাকার সম্পদে সিন্ডিকেটের বদনজর
   

রাজধানীর আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার কয়েক হাজার টাকা দামের সম্পত্তি নানা কায়দায় দখলে নিতে তৎপর সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের এই অপচেষ্টা অব্যাহাত আছে। সরলমনা মানুষের দানের টাকার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয়ের বিপুল উৎস রয়েছে। দোকান এবং সামনের কারখানা থেকে মাসিক ভাড়া পেলেও এতিমখানার জমিতে কনকর্ড টাওয়ার নামে ২১ তলা ভবন নির্মাণ হওয়ার পর জটিলতা বেড়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবতে বসেছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদপ্তর পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হলেই তাকে তাড়ানোর বন্দোবস্ত চলে।

স্থানীয়দের দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ সাজানো হলে সেখানেও ভাগ-বাটোয়ারায় বনিবনা না হলে দ্ব›দ্ব দেখা দেয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও হাজার কোটি টাকার এই সম্পদে খবরদারি চালান ইচ্ছেমতো। তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদের নামে সমাজসেবা অধিদপ্তরে অভিযোগের পর অভিযোগ জমা পড়লেও তিনিই সেখানে সর্বেসর্বা। তার কথাতেই সেখানে চলে সবকিছু।

স্টাফরাও চলেন তার ঈশারায়। সব সরকারের সময় ‘ম্যানেজ করে চলা’ হারুনের মতের বাইরে গিয়ে কেউ সেখানে টিকতে পারেন না। বেনামি সাজানো অভিযোগে পদ ছাড়তে বাধ্য হন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা। এতিমখানার অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটি অনিয়ম বন্ধে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণের জন্য দুই দফায় সুপারিশ করলেও মন্ত্রণালয়ে তা ঝুলে আছে দুই বছর ধরে। এর সুযোগ নিচ্ছে সিন্ডিকেট।

স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সদ্য পদত্যাগী প্রশাসক, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক সমীর মল্লিক জানান, এর বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিতে অনেকের নজর রয়েছে। কনকর্ডের টাওয়ারটিও অনেকের নজরে আছে। এটি মুসলিম এতিমখানা। সার্বিক বিবেচনা করেই পদত্যাগ করেছেন বলে দাবি করেন তিনি। তত্ত্বাবধায়কমণ্ডলীর সাবেক আহ্বায়ক, সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কামরুজ্জামান বলেছেন, সেখানে পদে পদে অনিয়ম আছে। এই সম্পত্তি রক্ষা করতে সরকারের তদারকি ও স্বচ্ছতা দরকার। তবে সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠা কষ্টকর।

হিবাসরক্ষণ কর্মকর্তা ইউসুফ মোল্যা জানান, দুই বছর পর পর দোকান ভাড়ার চুক্তি নবায়ন করা হয়। ভাড়ার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে জমা হয়। কনকর্ড টাওয়ার সম্পূর্ণ অবৈধভাবে অনিয়মের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। তারা আদালতের রায়ে হেরে গেছে। এখন এতিমখানার দখলের আছে পুরো ভবন। সলিমুল্লাহর উত্তরসূরী খাজা আলী মাদানী প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী সভাপতি দাবি করলেও সেই কমিটি অনুমোদন পায়নি বলেও জানান ইউসুফ।

জানা গেছে, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে একশ বছরের জন্য লিজ পাওয়া প্রায় ১৯ বিঘা (১৮ দশমিক ৮২বিঘা) জমি রয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার। সেখানে ভাড়ায় চলছে ৫৬টি দোকান, ব্যাংক এবং কারখানা। এরমধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত নিয়ে একযুগ আগে গড়ে উঠা কনকর্ড টাওয়ার নিয়ে কেলেঙ্কারী ও বিতর্কের শেষ নেই।

১৮ তলার স্থলে নিয়ম ভেঙে ২১ তলা ভবন নির্মাণের কাজ ২০১২ সালে শেষ হলেও আইনী জটিলতায় কনকর্ড কৃর্তপক্ষ সেটির স্বত্ব পাচ্ছে না। এতিমখানার স্টাফদের অনেকে সেখানে বসবাস করছেন। দখলদারিত্ব রাখতে সামনে ফটক বন্ধ করে এতিমখানার ভেতর দিয়ে করা হয়েছে প্রবেশপথ। এখানে ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে ১৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। আছে ৪২ জন স্টাফ।

সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেখানে অনিয়ম দানা বেঁধেছে। প্রশাসকরা দায়িত্ব পেয়ে অনিয়ম বন্ধ করতে গিয়ে অপদস্থ হয়েছেন। হারুন সেখানে সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। তার আছে সিন্ডিকেট। কয়েক হাজার কোটি টাকার এই সম্পত্তি ও সম্পদে অনেকের আছে বদনজর। সময় পরিক্রমায় পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব যারা

পেয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আছেই অনিয়মের জড়িত থাকার অভিযোগ। এ অবস্থায় সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে কয়েক দফায় প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হলেও তারা সেখানে টিকতে পারেনি। নানা কায়দায় প্রশাসক সরিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটি করা হয়েছে। সেখানেও আছে নয়ছয়ের অভিযোগ। এতিমখানা ছয়বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের থাকার নিয়ম আছে। কিন্তু নিয়ম না মেনে ১৮ ঊর্ধ্ব বয়সি হয়েও সেখানে থাকায় ২০১৭ সালে ৬১ জনকে এবং ২০২০ সালে ১২ ছেলে ও ৬ জন মেয়েকে হোস্টেল থেকে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের অভিযানে বের করে দেয়া হয়। স্থানীয়রা বলছেন, মানুষ অন্ধবিশ্বাসে রাতের অন্ধকারে এই এতিমখানায় হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত গোপনে দান করেন। যার কোনো হিসাব বা রশিদ থাকে না। এই টাকা পকেটস্থ হয়।

এদিকে অনিয়মের এন্তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সাল থেকে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। ২০২০ সালে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কামরুজ্জামানকে তত্ত্বাবধায়কমণ্ডলীর আহ্বায়ক এবং উপপরিচালক মো. রকনুল হক ও লালবাগ জোনের সহসমাজসেবা কর্মকর্তা-৫ জহির উদ্দিনকে সদস্য করা হয়। তারা ছাত্রী হোস্টেল সুরক্ষায় সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, ওয়াশরুম, অফিস সংস্কারসহ বেশকিছু কাজ করেন। তখন ৫৬টি দোকান বরাদ্দ প্রক্রিয়া ও এর ভাড়ার টাকা কোথায় যায়, এর তদন্ত হয়। সংস্কার কাজের জন্য তিন সদস্য করে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগ উঠে, এতিমখানা স্টাফদের অনেকে বেনামে দোকান বরাদ্দে জড়িত।

সেখানে ২০১০-২০ সাল পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। নেই কোনো রশিদ, হয়নি অডিট। তখন সবকিছু ডাটাবেজ করা হয়। দীর্ঘদিনের অনিয়মের তদন্ত শুরু হলে তখন বেনামে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক তদন্তে নামে। সমাজসেবা অধিদপ্তরও তদন্ত শুরু করে। পৃথক তদন্তে ওই অভিযোগের সত্যতা মিলেনি। এরপর ২০২২ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের যুগ্ম সচিব কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি এতিমখানা পরিচালনার জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে তৎকালীন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান ও সচিবের চাপে দুই বছরের জন্য একটি কমিটি অনুমোদন পায়। দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০২৪ সালের ২৬ মে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় লিখিত অভিযোগ দেন তৎকালীন সভাপতি আব্দুস শুকুর ইমন।

অধিদপ্তর তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তদন্ত কমিটি পুনরায় প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করে। এরপর গত ৮ অক্টোবর অধিদপ্তরের পরিচালক সমীর মল্লিককে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু তিনি সেখানে টিকতে না পেরে নানামুখী চাপের মুখে এক মাসের মধ্যেই পদত্যাগ করেন।

অধিদপ্তর সরাসরি পরিচালনার দায়িত্ব নিলে গত ১৪ অক্টোবর খাজা আলী মাদানী নামে এক ব্যক্তি নিজেকে স্যার সলিমুল্লাহর উত্তারাধিকার দাবি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী সভাপতি ঘোষণা করেন। তিনি একটি কমিটি তৈরি করে এতিমখানার ভেতরে নামফলক বসিয়ে দেন। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন তরুণ-যুবক নিয়ে প্রশাসক প্রত্যাহার করে তার কমিটির অনুমোদন আনতে দৌঁড়ঝাপ করলেও বিধিবহির্ভূত হওয়ায় সমাজসেবা অধিদপ্তর এর অনুমোদন দেয়নি। এর কয়েক বছর আগে নবাব সলিমুল্লাহর উত্তরাধিকার পরিচয়ে এক ব্যক্তি এতিমখানার কর্তৃত্ব নিতে গেলে প্রতারণার অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি সরকারিকরণের সুপারিশ করা হয়। চলতি বছরে ১৭ সেপ্টেম্বর আরেক প্রতিবেদনেও একই সুপারিশ করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মন্ত্রণালয় সেই সুপারিশের ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নেয়ায় সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র।

অভিযোগ আছে, এতিমখানার অনেক সম্পত্তি ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও হাজি মো. সেলিম এবং সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক ছলচাতুরি করে দখলে রাখেন। কাউন্সিলর থাকালীন মানিক ১২৬ বর্গফুটের একটি দোকান ভাড়া নিয়েছেন। ৯৭ মাসের ভাড়া বাবদ মানিকের কাছে এতিমখানার পাওনা রয়েছে ছয় লাখ ১১ হাজার ১০০ টাকা। মানিকের পাশাপাশি তার ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত মো. জসিম উদ্দিন প্রধান নামের একজন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুই বছরের চুক্তিতে ১২১ বর্গফুটের দোকান ভাড়া নেন। প্রতি বর্গফুট ৫০ টাকা হিসাবে দোকানটির ভাড়া নির্ধারিত হয়েছিল ছয় হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু জসিম শুধু প্রথম মাসের ভাড়া পরিশোধ করেন। ২০১৯ সালে তার দোকান ভাড়ার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি দোকান দখলে রাখেন।

এদিকে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত আসনের) বেগম শামসুন্নাহার (স্যার সলিমুল্লাহর উত্তরাধিকারী) এই এতিমখানার সভাপতি থাকার সময় ২০০৪ সালে এতিমখানার প্রশাসনিক ভবনের পেছনের সাড়ে আট বিঘা জমির দুই বিঘার ওপর ১৮ তলা ভবন নির্মাণের জন্য কনকর্ড কনডোমিনিয়াম লিমিটেডের সঙ্গে অসম চুক্তি করে এতিমখানার কার্যনির্বাহী কমিটি। চুক্তিতে শর্তজুড়ে দেয়া হয়, ভবনের ১২ শতাংশ পাবে এতিমখানা ও ৮৮ শতাংশ পাবে কনকর্ড। সাইনিং মানি হিসেবে এতিমখানা পাবে ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু এ বিষয়ে নানা বাধার কারণে সে সময় ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গেলে ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার নির্বাহী কমিটির প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। আর কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় বেগম শামসুন্নাহার আহসানুল্লাহর ছেলে খাজা জাকি আহসানুল্লাহ সানিকে। এ সময় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের প্রভাবে ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১২ সালে শেষ হয় ১৮ তলা আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কাজ। ২০১৩ সালে এতিমখানার চার শিক্ষার্থী হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন করেন।

২০১৬ সালে আদালত কনকর্ড কনডোমিনিয়াম লিমিটেডের সঙ্গে করা চুক্তিকে অসম, জালিয়াতি ও বেআইনি ঘোষণা করে তা বাতিল করে দেন। একই সঙ্গে জমিসহ পুরো ভবন এতিমখানার অনুকূলে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেন। এছাড়া এই চুক্তির সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসককে আদেশ দেন। ২০১৬ সালে এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়।

২০১৭ সালে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের উদ্যোগে কনকর্ড কনডোমিনিয়াম লিমিটেড ও এতিমখানার সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটি ওই রায়ের বিরুদ্ধে তিনটি আপিল করে। ২০১৮ সালের ১২ মার্চ আপিল বিভাগ তিনটি আপিলই খারিজ করে দেন। এরপর বিবাদীপক্ষ আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল করে। ২০২২ সালের ৯ জুন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ওই রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন।

এদিকে কনকর্ড টাওয়ারের নাম বদল করে স্যার সলিমুল্লাহ কমপ্লেক্স নাম দিয়ে গত ৩০ মে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সম্পাদক মো. সাব্বির আহমেদ সাখাওয়াত আলী, মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ ও নূরে আলম নামে তিন ব্যক্তির সঙ্গে ভবনটি ব্যবহার উপযোগী করতে দায়িত্ব দিয়ে একটি চুক্তি করেন। যেখানে ভবনের দখল হস্তান্তরকারী এবং দখল গ্রহণকারী দুটি পক্ষ উল্লেখ করা হয়েছে। এমন চুক্তির নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্টাফ জানিয়েছেন, এতিমখানার সাবেক ছাত্র হারুন অর রশিদ ২০২০ সালে এতিমখানায় জালসনদে অস্থায়ী পদে শারীরিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। চাকরি পেয়েই গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। শৃঙ্খলাভঙ্গ, দোকান ভাড়ার টাকা নয়ছয়, একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক, স্টাফদের নির্যাতন এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক তদন্তে প্রমাণ মিলে।

এতিমখানার স্বার্থবিরোধী কাজ করার অপরাধে ওই বছরই হারুনসহ পাঁচজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করেন এতিমখানার তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মামুন। মামলা নম্বর ৩৫(১১) ২০২০। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। চাকরিচ্যুত হলেও এতিমখানা ছাড়েননি হারুন। ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৪ সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়।

কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাব্বির আহমেদ, সহসভাপতি সুমি আলম, কোষাধ্যক্ষ শহীদুল ইসলাম, কমিটির সদস্য এবং গোপালগঞ্জ যুব মহিলা লীগের সভাপতি পর্শিয়া সুলতানা, ওলামা লীগ নেতা সাগর আহমেদ শাহিন, সদস্য মোহাম্মদ আলী সোহেল এবং উপদেষ্টা কমিটির সদস্য শাখাওয়াত আলী জুয়েলসহ কয়েকজনকে নিয়ে এতিমখানায় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন হারুন। তখন কমিটির সভাপতি আব্দুস শুকুর ইমন, সহসভাপতি আবু নাসের ইকবালসহ কয়েকজন এতিমখানায় প্রবেশ করতে পারেননি। আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় হারুনসহ পাঁচজনকে চাকরি ফিরিয়ে দেয় সিন্ডিকেট। চাকরি ফিরে পেয়ে হারুন সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ করে তত্ত্বাবধায়ক পদ দখলে নেন।

এরপর হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নুরসাত আলমকে চাকরিচ্যুত করেন। ইচ্ছেমতো বিভিন্ন পদে ১৬ জনকে নিয়োগ দেন। আপত্তি উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যবাহী ২৬টি গাছ বিক্রি করা হলেও এতিমখানার ফান্ডে জমা হয়নি এক টাকাও। এতিমখানা সংস্কারের কথা বলে বিভিন্ন সময় অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করে তা আত্মসাৎ করা হয়। হারুনসহ পাঁচজনকে চাকরিতে পুনর্বহালের পর তাদের বকেয়া বেতনের কথা বলে এতিমখানার ফান্ড থেকে ২৫ লাখ টাকা তুলে নেয় সিন্ডিকেট। এছাড়া এতিমখানার একটি দেয়াল নির্মাণের কথা বলে ২৫ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করে।

তত্ত্বাবধায়কের বাসা মেরামতের জন্য নেয় ৭ লাখ টাকা। হাইকোর্টের আদেশে পাওয়া কনকর্ডের নির্মাণাধীন ভবনের মালামালও লুট করে এই চক্রের সদস্যরা। সর্বশেষ ঢাকার নিউ মার্কেটের আমলী আদালতে ২৪ অক্টোবর দায়ের করা মামলায় ৫৮ জন আসামির মধ্যে হারুনকে ৮ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এতে গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা কলেজের উত্তর পাশে বাবুবাজার কাগজ ফ্যাক্টরির কর্মচারী নাঈম গুলিতে আহত হওয়ার অভিযোগ করেছেন তার বাবা আ. সাত্তার মিয়া। মামলা দায়েরের পরও হারুন আছেন বহালে।

হারুনের ভাষ্য : এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ জানান, তার বিরুদ্ধে করা সব অভিযোগ মিথ্যা ও সাজানো। তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। এতিমখানার সম্পত্তি রক্ষা করতে চাওয়ায় একটি চক্র ২০১২ সাল থেকে তাকে নানাভাবে হয়রানি করে আসছে। কনকর্ড গ্রুপের টাকার অফার প্রত্যাখ্যান করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, তিন ব্যক্তির সঙ্গে মাসিক ৭৫ লাখ টাকা ভবন ভাড়ার চুক্তি বাতিল হয়েছে। সভাপতি দাবি করা খাজা আলী মাদানী নবাব সলিমুল্লাহর চতুর্থ বংশধর দাবি করে হারুন আরো জানান, কমিটি অনুমোদন করা সমাজসেবা অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। তার দাবি, সেখানে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় তার ও এতিমখানার ছাত্রদের নামে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনে নাইম আহত হওয়ার মামলায় নাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হার্নিয়া অপারেশনের জন্য তখন তিনি পপুলার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। গণমামলায় কেউ তার নাম ঢুকিয়ে হয়রানির চেষ্টা করছে। এ ঘটনায় জড়িত তিনজন ধরা পড়েছে। তদন্তে অন্যরাও ধরা পড়বে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তিনজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছেন তিনি।

স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সম্পত্তি রক্ষায় আইনি লড়াই করেছেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে অবগত। সুপ্রিম কোর্টের এই সিনিয়র আইনজীবী জানান, কনকর্ড টাওয়ারের বিপরীতে মামলা করে তিনি এতিমখানার পক্ষে রায় পেয়েছেন। এতিমখানায় অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন অভিযোগ তিনি বিভিন্ন সময় শুনেছেন, পেয়েছেন। হারুন অর রশিদ নামে এক স্টাফের নামে এর আগে মামলা হয়েছিল। তিনি জেলেও ছিলেন। দুর্নীতি-অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে এর তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

টাইমলাইন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App