সন্নাসীর জামিন ঘিরে তুলকালাম

চট্টগ্রাম অফিস :
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে আদালত জামিন না দেয়া, সনাতনীদের ওপর পুলিশ-বিজিবি সদস্যদের বেধড়ক লাঠিচার্জ ও সংঘর্ষে এক আইনজীবী নিহত হওয়ার ঘটনায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনজীবী নিহতের ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি আজ বুধবার চট্টগ্রামের সব আদালত বর্জন ও বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে।
এদিকে সন্ধ্যার পর নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার, পাথরঘাটাসহ কয়েকটি এলাকার মন্দিরে উশৃঙ্খল ও উগ্রবাদী কিছু দুষ্কৃতকারী হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, লালদীঘি-কোর্টবিল্ডিং-কোতোয়ালি এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল।
গতকাল মঙ্গলবার বিকাল আনুমানিক ৪টার দিকে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের নিহত হন। তার বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। বাবার নাম জামাল উদ্দিন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তবে ঠিক কাদের হামলায় আলিফ নিহত হয়েছেন তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। আহত যে কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- শ্রীবাস দাশ, শারকু দাশ, ছোটন, সুজিত ঘোষ, উৎপল ও এনামুল হক।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বেলা ১১টার দিকে চিন্ময় কৃষ্ণকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণজুড়ে পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা বলয় ছিল। দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রামের ষষ্ঠ মহানগর হাকিম কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে তাকে উপস্থাপন করা হয়। এ সময় চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীরা তার জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এরপর আইনজীবীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে চিন্ময় কৃষ্ণকে করাগারে ডিভিশন ও ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের সুযোগ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে শুনানি চলাকালে এজলাসের বাইরে আইনজীবীসহ বিপুলসংখ্যক তরুণ-যুবক জড়ো হন। তারা চিন্ময় কৃষ্ণের পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকেন। জামিন নামঞ্জুরের খবরে তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরমধ্যেই চিন্ময় কৃষ্ণকে আদালত ভবনের দোতলা থেকে নামিয়ে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। তখন সবাই প্রিজন ভ্যানের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এতে প্রিজন ভ্যান আটকে যায়। প্রায় ১৫ মিনিট আটকে থাকার পর চিন্ময় কৃষ্ণ ভ্যানের ভেতর থেকে হ্যান্ডমাইকে বক্তব্য রাখেন। তিনি সবাইকে শান্ত থাকার ও ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়, এমন কোনো কর্মকাণ্ড না করার আহ্বান জানান। এরপর প্রিজন ভ্যান ফের কারাগারের উদ্দেশে রওনা দেয়।
এসময় অনেকে প্রিজন ভ্যানের সামনে শুয়ে পড়ে বিক্ষোভ দেখান। এভাবে প্রায় তিন ঘণ্টা তারা প্রিজনভ্যান আটকে রাখার পর বেলা ৩টার দিকে পুলিশ অ্যাকশনে যায়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিচার্জ শুরু করে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায়ও আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। এ সময় আইনজীবীদের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এরপর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে রঙ্গম কনভেনশন হলের সামনে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা। এ সময় একদল আইনজীবীও আদালত ভবন থেকে বিক্ষোভ করে নিচে নামেন। সেই সঙ্গে নগরীর টেরিবাজার এলাকা থেকেও ‘নারায়ে তকবীর’ স্লোগান দিয়ে একটি মিছিল রঙ্গম কনভেনশন হলের দিকে অগ্রসর হয়।
পাশাপাশি জহুর হকার মার্কেট ও তামাকুমন্ডি লেইন এলাকা থেকেও একই ধরনের মিছিল নিয়ে সনাতনীদের ওপর হামলা চালানো হয়। ফলে সনাতনীরা কিছুটা পিছু হটে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে দুপক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন। তাদের উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে মৃত ঘোষণা করেন।
সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়ে চমেক হাসপাতাল ছাড়া চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৯ জন। তবে এই ১৯ জনের সবাই আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল মান্নান। তিনি বলেন, কেউ মাথায় আঘাত পেয়েছেন, কেউ হাতে, কেউ শরীরের অন্যান্য জায়গায় আঘাত পেয়ে আহত হয়েছে। তাদের হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি দেয়া হয়েছে।
আদালত বর্জনের ঘোষণা আইনজীবীদের : দুষ্কৃতকারীদের হামলায় আইনজীবী নিহতের প্রতিবাদে সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতি। আজ বুধবার সব আদালতে এ কর্মসূচির পালনের ঘোষণা দেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক। আইনজীবী আলিফের মৃত্যুর খবর পেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় চমেক হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, কোর্ট বিল্ডিং থেকে যাওয়ার পথে ওরা যে যেদিকে পেরেছে হামলা করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে, মসজিদের গ্লাস ভাঙচুর করেছে। শুধু তাই নয়, সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে আমাদের একজন আইনজীবীকে ধরে মেথর পট্টিতে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে ইসকনের সন্ত্রাসীরা। এর প্রতিবাদে আমরা সমিতির পক্ষ থেকে জরুরি মিটিং ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মহানগর দায়রা জজ, জেলা দায়রা জজ, মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সব আদালতের কার্যক্রম সাসপেন্ড ঘোষণা করছি।
তিনি আরো বলেন, আমরা নিহত আইনজীবীর পরিবারের সদস্যদের জন্য অপেক্ষা করছি। পরিবারের সদস্যরা হয়তো লোহাগাড়া থেকে আসবে। তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ভিডিও ফুটেজ দেখে যারা এই হত্যাকাণ্ডে ছিল তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব। ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনে নিহত আইনজীবী সাইফুল সবার সামনে ছিল বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার তারেক আজিজ (মিডিয়া) বলেন, কাদের হামলায় আইনজীবী নিহত হয়েছেন তা তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে নগরীতে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দোষী যে বা যারাই হোন না কেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। যদিও রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি।
দুই মন্দিরে আগুন : সনাতনী জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাসের জামিন না পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও আইনজীবী নিহতের পর গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে পাথরঘাটার সেবক কলোনিতে (মেথরপট্টি) আগুন দিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। স্থানীয় অধিবাসীরা অভিযোগ করেছেন, সন্ধ্যার পর ইসলামী স্লোগান দিয়ে একদল মানুষ মেথরপট্টিতে ঢুকে মন্দিরে ব্যাপক ভাংচুর করে ও আগুন লাগিয়ে দেয়। এসময় অন্তত ৭ জনকে ব্যাপক মারধর ও দুজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এরপর রাত ৮টার দিকে নগরীর কোতোয়ালি থানার পেছনে জগবন্ধু আশ্রমেও ভাঙচুর ও আগুন লাগিয়ে দেয় একদল উশৃঙ্খল দুর্বৃত্ত।
উল্লেখ্য, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সাম্প্রতিককালে বেশ আলোচিত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অবস্থিত ইসকন মন্দির পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ। পাশাপাশি বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র তিনি। গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জনসভার পর ৩০ অক্টোবর রাতে তাকেসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। সোমবার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা তাকে আটকের পর ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।