প্রত্যাশার চাপে হিমশিম

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ভঙ্গুর অর্থনীতি, ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা ও বিধ্বস্ত প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে গত ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ক্যালেন্ডারের হিসাবে ১০০ দিন পার করেছে এ সরকার। বিপুল প্রত্যাশার চাপ আর নানামুখী চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করা সরকারের অগ্রাধিকার ছিল অর্থনীতিকে সচল করা, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করা এবং রাষ্ট্র মেরামতের।
দীর্ঘদিনের দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কাঠামোগত সংস্কার শেষে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউনূস। কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ না করলেও, তিনি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আর এ শতদিনের মধ্যেই বিএনপিসহ গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো থেকে তাগিদ এসেছে ‘যৌক্তিক’ সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। প্রশাসনিক কাঠামো উন্নত করা, সংস্কার পরিকল্পনা নির্ধারণ, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাসহ কয়েকটি বিষয় রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারে।
সরকারের ১০০ দিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে মোটা দাগে বড় অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন, অর্থনৈতিক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে আনতে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন, গুম তদন্তে কমিটি গঠন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্টে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, বহুল বিতর্কিত সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের সিদ্ধান্ত, জুলাই-আগস্টে হতাহতদের তালিকা প্রকাশ এবং তাদের সহায়তায় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন। ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সচল করতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপ ছিল লক্ষণীয় ও ফলদায়ক। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলেও উন্নতি হয়েছে।
তিন মাসে সরকারের অর্জন সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিগত শাসনামল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আর্থিক, পুঁজিবাজার ও ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন খাতের সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। শ্বেতপত্র কমিটি, অর্থনীতি পুনঃকৌশলীকরণ কমিটি এবং অন্যান্য কমিটি গঠন- এসব খাতে সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে; অন্যথায় সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর্থিক খাত, ব্যাংকিং খাত এবং পুঁজিবাজার সংস্কার করা হচ্ছে। বাজারের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ ও সিকিউরিটিজ ট্রেডিংয়ে হেরফের রোধে একটি টাস্কফোর্স কাজ করছে।
সরকার ঋণ পরিশোধে চিন্তিত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার ব্যবহারে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে এবং নিজের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তিনি বলেন, বাজেটে আরো চাপ আসতে পারে, তবে বাজেট সংশোধনের সময় বিশেষ করে উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে তা পর্যালোচনা করা হবে।
সংস্কারের চ্যালেঞ্জ : দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে দশটি কমিশন গঠন করেছে, যেগুলো বছরের শেষে সংস্কারের সুপারিশ করবে। অনেকে চাইছেন, ড. ইউনূস আরো এক বা দুই বছর ক্ষমতায় থাকুন, যেন তিনি পরিকল্পিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেন। তারা আশঙ্কা করছেন, যদি তাকে দ্রুত নির্বাচন করতে হয়, তাহলে কাক্সিক্ষত পরিবর্তনগুলো করা সম্ভব হবে না। তবে, বর্তমান সরকারের ১০০ দিনে দেখা গেছে, প্রশাসনে পদোন্নতি, বদলি, চাকরিচ্যুত ছাড়া তেমন কোনো বড় পরিবর্তন হয়নি। তিন মাসের বেশি সময় পরও এখনো আমলারা নিজেদের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। প্রশাসনে এখনো গতি আসেনি পুরোদমে। সরকারও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একের পর এক দাবি-দাওয়া মেনে নিচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সত্যিকার অর্থে কতটা জনপ্রশাসন সংস্কার হবে- তা নিয়েও সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেছিলেন, টেবিলের ওপর জগ থাকবে না প্লাস্টিকের বোতল থাকবে, এটা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। এটা কোনো পরিবর্তন নয়। পুলিশের জার্সি চেঞ্জ হবে না লোগো চেঞ্জ হবে, স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন হবে- এটি মুখ্য ব্যাপার নয়। সে সময় ‘সংস্কারের রোডম্যাপ’ না দেয়ার সমালোচনাও করেন তিনি।
সরকারের মূল অর্জনগুলো নিয়ে গতকাল শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম লিখেছেন, ইতোমধ্যে দশটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে কমিশনগুলো। সেই রিপোর্টগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সে বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করা হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আলাদাভাবে নির্বাচনের জন্য নতুন ও গ্রহণযোগ্য সিইসি ও ইসি খুঁজতে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে ভোটার তালিকা তৈরির কাজ শুরু করা হবে।
এর আগে ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারও সংস্কারের ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়, ব্যর্থ হয় তাদের সংস্কার প্রচেষ্টা।
অর্থনীতির সংস্কার : আওয়ামী লীগের শাসনামলের গত দেড় দশকে ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে নতুন করে সাজাতে অন্তর্বর্তী সরকার ১০০ দিনে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু জুলাই-আগস্টের আন্দোলন, পরবর্তীকালে শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রভাব রয়েই গেছে। বিশেষ করে শিল্প-কারখানার উৎপাদনে বড় সংকট তৈরি হয়েছে। অনেক উৎপাদনশীল কোম্পানিও এখন ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকের তারল্য সংকট, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, বাজার অব্যবস্থাপনাসহ ব্যবসাবাণিজ্যে এখনো অস্থিরতা রয়েই গেছে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির অন্তত তিনটি প্রধান সূচক- রপ্তানি, প্রবাসী আয় ও আমদানিতে গতি ফিরলেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষত, খাদ্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে পারছে না অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছে লাগামহীন। এক মাসের ব্যবধানে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ২ দশমিক ২৬ শতাংশ।
মোটা দাগে গত আওয়ামী লীগ সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাজারে যে সিন্ডিকেট রেখে গেছে, তা কোনোভাবেই দমানো যায়নি। সিন্ডিকেট না ভেঙে উল্টো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার ক্রমশ বাড়ছে। ইতোমধ্যে সুদের হার প্রায় ১৬ শতাংশে উঠেছে। শেয়ারবাজারে রেকর্ড তলানির মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার বার্তায় লিখেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ছিল। তবে দায়িত্ব নেয়ার ১০০ দিনের মাথায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসা শুরু হয়েছে। রিজার্ভে হাত না দিয়েই বিলিয়ন ডলারের পেমেন্ট পরিশোধ করা হয়েছে। রপ্তানি খাতেও সুবাতাস বইছে, সেপ্টেম্বরে ৭ শতাংশ এবং অক্টোবরের ২০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় বেড়েছে। ব্যাংকিং খাত অনেকটা স্থিতিশীল হয়েছে। অর্থনীতিকে পুনরায় গতিশীল করতে দেশের সেরা অর্থনীতিবিদদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।
তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসেছে নতুন নতুন নেতৃত্ব। আর্থিক খাতে চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগই বাতিল করেছে সরকার। রাজনৈতিক প্রকল্পে ব্যয় খতিয়ে দেখার পাশাপাশি অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে শ্বেতপত্র প্রণয়নে কমিটি গঠন করেছে সরকার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের আর্থিক খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে কমিটি। ইতোমধ্যে গত আওয়ামী লীগ সরকারের লুটপাটকারী শতাধিক মন্ত্রী-এমপি, দলীয় নেতা, সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকার যেসব উদ্যোগ নিতে পারেনি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার ১০০ দিনের মধ্যেই সেসব উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে অর্থনীতি আর আর্থিক খাতের পুনর্গঠনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ বিষয়ে পরিষ্কার একটি বার্তাও এসেছে অর্থনীতিবিষয়ক নেতৃত্বের কাছ থেকে। তবে নীতি সুদহার কিছুটা বাড়ানো ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখনো বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসায় শিল্প খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সুফল পেতে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। মূল্যস্ফীতি, বাজার ব্যবস্থাপনাসহ কিছু বিষয়ে এখনো শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়ার সময় আছে। আর শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্স কমিটির সুপারিশ পাওয়ার পর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের পথ পাওয়া যাবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) ইতোমধ্যে জানিয়েছে, অর্থনীতিতে সংস্কার আনার জন্য ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে হবে।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি উচ্চ মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখিতা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব নেয়ার পর ইতোমধ্যে কয়েক দফা নীতি সুদহার বাড়িয়েছেন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। নীতি সুদহার বেড়ে এখন ১০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। নতুন গভর্নরের নির্দেশনায় ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল ১১ ব্যাংকে (যাদের সিংহভাগই এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল) নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। রিজার্ভ সংকট কাটাতে আমদানি কমিয়ে সীমিত পর্যায়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
পাশাপাশি আমদানির ক্ষেত্রে জোর তদারকিরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাছাড়া দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দিতে বেসরকারি অন্য ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। তারল্য সংকট ধীরে ধীরে কাটছে। ডলার সংকট কাটাতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত তিন মাসে এর ফলও এসেছে। ডলার বিক্রি না করে, ঋণ পরিশোধ করেও রিজার্ভ বাড়ছে। বিশেষ করে গত সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধ করার ফলে রিজার্ভ কিছুটা কমলেও চলতি সপ্তাহে তা আবার ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ার কথা রয়েছে। গত দুই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ২৪০ কোটি ডলার করে। অক্টোবরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ২১ শতাংশ। সব মিলিয়ে বিদেশি মুদ্রার প্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, ব্যবসাবাণিজ্য ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে এখনো উদ্বেগের জায়গা আছে। এখানে এখনো শক্তিশালী কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে, সেগুলোর ফল পেতে এখনো সময় লাগবে। কিছু পদক্ষেপ আরেকটু প্রাসঙ্গিক করে করলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে, কিন্তু পাশাপাশি আরো কিছু পদক্ষেপ যেমন রাজস্বনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনায় আরো শক্তিশালী উদ্যোগ নেয়া দরকার।
গত ১০০ দিনে ব্যবসাবাণিজ্যের স্থিতিশীলতাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে আগস্টের শেষদিকে শুরু হওয়া পোশাক খাতে শ্রমিকদের আন্দোলন এখনো চলছে। পোশাক শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেয়ার পরও গাজীপুর ও আশুলিয়ার শিল্প এলাকায় অস্থিরতা থামছে না। এরই মধ্যে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এগুলো আগের ক্রয়াদেশের ফল। শ্রম অস্থিরতার কারণে গত তিন মাসে ৪০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশের ক্ষতি হয়েছে বলেও জানিয়েছিল পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ। আগামী কয়েক মাস রপ্তানি আয় কমতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
পাচারের অর্থ ফেরাতে একগুচ্ছ উদ্যোগ : বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে বিশ্বের ১২টি দেশে ৭১টি চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ২৭টি চিঠির জবাব পেয়েছে সংস্থাটি। দুদক কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্বের ১২টি দেশে টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে দুদক। বিভিন্ন দেশে বাড়ি, গাড়ি ক্রয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগসহ ব্যাংকে টাকা রাখা হয়েছে। টাকা পাচার করা দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, সাইপ্রাস, জাপান, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া। যারা এসব দেশে টাকা পাঠিয়েছেন, তাদের বিষয়ে ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৭১টি এমএলএআর পাঠানো হয়েছে।
গত এক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনসহ (এফবিআই) চারটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এসে কমিশন ও এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা পাচারকৃত অর্থ ও সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রথম দফায় দুদক সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পাচারের টাকা ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সম্পদ বাজেয়াপ্ত সংক্রান্ত আদালতের আদেশ এমএলএআরের (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট) মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে পাঠানো হবে।
এরপর ধাপে ধাপে আরো অর্ধশতাধিক প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী-এমপির পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের শতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অবৈধ অর্থ-সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫২ জনের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দুদকের হাতে রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩০ জন সাবেক মন্ত্রী এবং ২২ জন সাবেক এমপি ও প্রভাবশালী রয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি : অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর গত ১০০ দিনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়েছে। একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। সেখানে প্রকাশ্যে গণছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র মহড়া এবং বিহারি ক্যাম্পে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সেভাবে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি।
মূলত, ৫ আগস্টের পর হামলার শিকার পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাগুলোর সবগুলো এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ছাত্র আন্দোলন দমনে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে পুলিশ বাহিনী যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল, সেটিও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামায় নতুন সরকার। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও জনমনে আতঙ্ক রয়েই গেছে। অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা স্বাভাবিক হবে সেটা নির্ভর করে সেই দেশের থানাগুলোর কার্যক্রমের ওপর।
এদিকে, সারাদেশে গত তিন মাসে তথাকথিত মব জাস্টিসে (দলবদ্ধভাবে জোর করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া) ৬৮ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র। একই সময়ে, কমপক্ষে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলেও জানায় সংস্থাটি। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে হামলা ও লুটপাটের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেই প্রশ্ন উঠছে।
মব জাস্টিসের মধ্যে ফেলে মানুষ হত্যা এবং এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আন্তরিকভাবে কাজ করছে। ঢাবি, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রামের ঘটনায় অপরাধীরা আইনের আওতায় এসেছে। সব ঘটনায় অপরাধীদের ধরা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় ৯৯৯ বা থানা-পুলিশের সহায়তা নেয়ার আহ্বান রইল।
এদিকে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাতে সংস্কার করতে কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। যারই ধারাবাহিকতায় পুলিশকে আগের খোলস থেকে বের করে আনতে এ বাহিনীতে সংস্কারের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, দক্ষ ও নিরপেক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে প্রধান করে ৯ সদস্যের পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচনের অগ্রগতি : বাংলাদেশে পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে গত অক্টোবরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। সরকার বলছে, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেয়া হবে। এটি একটি প্রতিশ্রুতি, যা আমরা দিয়েছি। বার্তা সংস্থা এএফপিকে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন দেব।’
আজারবাইজানে জলবায়ু সম্মেলনে গিয়ে এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। এ ব্যাপারে সরকারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সেই নির্বাচন কত দ্রুত সময়ের মধ্যে হবে, সংস্কারের গতিই সেটা বলে দেবে। তিনি আরো বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কম হওয়াই যৌক্তিক। কিন্তু সংস্কার শেষ হতে কতদিন লাগবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। এর আগে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।
সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলা হলেও বিএনপি চাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোট হোক। সমপ্রতি বিবিসি বাংলাকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যত দ্রুত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকে সরকারের কাছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোড ম্যাপ চাওয়া হয়েছে। দলটির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোও নির্বাচনের রোড ম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দলগুলোর সংলাপেও রোড ম্যাপের কথা উঠে এসেছে বারবার। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে ইতোমধ্যেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সার্চ কমিটি দল, ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছ থেকে নতুন কমিশনারদের নামের প্রস্তাবও নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। নতুন কমিশন গঠনের পর নির্বাচনী প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হতে শুরু করতে পারে।