বহুমাত্রিক সম্পর্কের বার্তা

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ সফর করছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একটি প্রতিনিধি দল। আজ রবিবার সফরে আসা মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে চলমান অর্থনৈতিক সংকটসহ আন্তর্জাতিক, অভ্যন্তরীণ ও ভূ-রাজনীতি মোকাবিলায় সহযোগিতার বিষয়টি। পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
তবে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার হবে এ সফরে। পাশাপাশি আলোচনায় গুরুত্ব পাবে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়। উচ্চপর্যায়ের এ দলের সঙ্গে বহুমাত্রিক আলোচনা হবে বলে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে মার্কিন প্রতিনিধি দলের এ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মার্কিন প্রতিনিধি দলটি দুদফায় ঢাকা পৌঁছায় গতকাল শনিবার। এদিন সকালে প্রথম দফায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের দলটি ঢাকায় আসে। এরপর বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে দিল্লি থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। সবমিলিয়ে ৬ সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধি দল এলেও মূল কৌতূহল ডোনাল্ড লু’কে নিয়ে। সর্বশেষ গত কিছুদিন ধরে ঘন ঘন ঢাকা সফর করে যাওয়া ডোনাল্ড লু এবার কী আলোচনা করবেন সেটা নিয়েই নানা বিশ্লেষণ হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুুক একজন সরকারি কর্মকর্তার মতে, ডোনাল্ড লু ওয়াশিংটন থেকে গত ১০ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে দিল্লি এসেছেন। এরপর সেখানে ‘টু প্লাস টু’ শীর্ষক এক বৈঠকে যোগদান করেন। সেই বৈঠক সেরে গতকাল শনিবার ঢাকায় এসেছেন। তার মতে, ওয়াশিংটন সরাসরি ঢাকায় আসে না, দিল্লি হয়ে আসে। গত ডিসেম্বরেও ডোনাল্ড লু দিল্লি এসেছিলেন এবং ‘টু প্লাস টু’ শীর্ষক বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। এরপরই জানুয়ারিতে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। এবারো তিনি দিল্লিতে ‘টু প্লাস টু’ শীর্ষক বৈঠক সেরে এসেছেন। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, ডোনাল্ড লু এবার কী কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন, নাকি কোনো বার্তা নিয়ে যাবেন?
জানতে চাইলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতের দায়িত্ব পালন করে আসা কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যবসা, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনীতি নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।
মার্কিন প্রতিনিধি দলের এই সফরটি মূলত রাজনৈতিক জানিয়ে তিনি বলেন, আজ রবিরার প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পরই সফরের তাৎপর্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পরিবর্তনকে অভূতপূর্ব উল্লেখ করে বলেন, এই ঘটনা হয়তো কেউই আগে থেকে টের পাননি। এই অবস্থায় মার্কিন প্রতিনিধি দল বিশেষ করে আলোচিত ডোনাল্ড লু কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন; নাকি বার্তা দিয়ে যাবেন- তা সরকারের সঙ্গে বৈঠকের পরই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে দিল্লি এবং ওয়াশিংটনের একসঙ্গেই কাজ করতে হবে। কাজের আকার কী হবে তা আলোচনায় ঠিক হবে। তবে এটা ঠিক প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সচিবের সঙ্গে মার্কিন বৈঠকের পরই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক এবং ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশে অবস্থান খোলাসা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মার্কিন প্রতিনিধি দলের এ সফরে দুদেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হবে। সফরের প্রথম দিনই গতকাল শনিবার মার্কিন প্রতিনিধি দল ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। প্রতিনিধি দলের মূল বৈঠক হবে আজ রবিবার। মার্কিন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আজ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন।
পরে প্রতিনিধি দলটি পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সভায় অংশ নেবেন। ওই দিন বিকালে প্রতিনিধি দলের প্রধান নেইম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দলে ডোনাল্ড লু ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপ-সহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কাউর, যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ রয়েছেন।
পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের আলোচনা শুরু করার আগে আমি কোনো ধরনের মন্তব্য করতে চাই না, যেটি আলোচনার স্বাভাবিকতা ক্ষুণ্ন করে। আমি শুধু এটি বলতে পারি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রতিনিধি দল আসছে; তারা যে এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় সেটির বড় প্রতিফলন ঘটছে এর মাধ্যমে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের চাহিদা মেটাতে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহায়তা করতে পারে, তা নিয়ে আলোচনার জন্য ওয়াশিংটন থেকে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করবে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সুশাসন নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বেশ সরব অবস্থানের জানান দেয় ওয়াশিংটন। তবে তাতে গুরুত্ব দেয়নি শেখ হাসিনা সরকার। আর এতে করে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক যেমন তলানিতে গিয়েছে; তেমনি ভিসানীতির মতো কিছু শাস্তিও পেতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। সরকার পতনের তিন দিনের মাথায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। নতুন সরকার গঠনের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিনন্দন জানিয়েছে।
পাশাপাশি দেশ গঠনে ড. ইউনূসকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। আর ইউনূস সরকারও দায়িত্ব নেয়ার পর মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দিয়ে গুমবিরোধী সনদে সই করেছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উৎসাহের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে এই প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসার আগে দিল্লি গিয়েছেন। এ নিয়ে বিশেষ কৌতূহল তৈরি হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লিতে অবস্থান করছেন। এমন পরিস্থিতিতে দিল্লিতে ভারতের সঙ্গে মার্কিন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
জানতে চাইলে প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার সভাপতি গৌতম লাহিড়ী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, দুপক্ষের মধ্যে দিল্লিতে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, ইন্দো-প্যাসিফিকের বিষয় নিয়ে আলোচনায় কী সিদ্ধান্ত হয়েছে তা নিয়ে কোনো পক্ষই মুখ খোলেনি।
তিনি বলেন, বৈঠক-পরবর্তী কয়েকটি এক্স (সাবেক টুইট) বার্তায় দেখা গেছে, আগের বৈঠকের ধারাবাহিকতায় নতুন বৈঠকটি হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক কেমন হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। ভারত বাংলাদেশকে ডিম পাঠিয়েছে। সামনে পেঁয়াজসহ নানা জিনিসও পাঠাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরা তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র : বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ঢাকা সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দল আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচ্যাম) নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই আগ্রহ ব্যক্ত করে। বৈঠকের পর ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এক বার্তায় জানায়, জ্বালানি নিরাপত্তা থেকে শুরু করে ডেটা সেন্টার এবং পরিবহন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। সঠিক অর্থনৈতিক সংস্কার করা হলে আমেরিকার বেসরকারি খাত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনে সহায়তা করতে পারে।
এর আগে গতকাল শনিবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের প্রধান রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় আসেন। এ দিন বিকালে দিল্লি হয়ে ঢাকায় পৌঁছান প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আজ রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। পরে প্রতিনিধি দলটি পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে মধ্যহ্নভোজে অংশ নেবে। ওই দিন বিকালে প্রতিনিধি দলের প্রধান নেইম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুরের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।