রক্তাক্ত আগস্ট
বাঙালির কৃষ্ণপক্ষ

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘চিৎকার, ক্রন্দন আর শশব্যস্ত আহ্বানের মাঝে/উল্লাস করছে অন্ধ জনতা।/ ওরা বলে, ‘এখন ভোর’, কিন্তু জীবনপানে তাকিয়ে/ আমি দেখি রাত্রি, ঘোর অমানিশা।’ পঁচাত্তরের পনের আগস্ট বাংলার আকাশের ঘোর কৃষ্ণপক্ষকে ‘আকাশ প্ল্যানেট’ কবিতায় এভাবেই তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের শ্রেষ্ঠ কবি মীর গুলবাগ খান নাসির। বাঙালির ক্যালেন্ডারে বছরের সবচেয়ে নির্মম মাস আগস্ট। শোকের মাস আগস্ট। ৪৯ বছর আগে এই আগস্টেই ঘাতকের নির্মম বুলেটে সপরিবারে প্রাণ হারান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আগস্ট এলেই ঘাতকের উদ্যত সঙ্গিন আর পিতৃহন্তারকের নির্মম বুলেটে গুমরে কাঁদে রক্তাক্ত বিবেক। থেমে যায় সব কোলাহল। থমকে যাওয়া সময়ে পিতৃহারানোর শোকে মুহ্যমান হয় জাতি।
আগস্টের কালরাতে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করে ঘাতকরা জাতির ললাটে এঁকে দেয় পিতৃহন্তারকের কালিমা লেখা। ক্যালেন্ডারে আগস্ট আসা মানেই পিতৃহারা জাতির বিলাপ বারবার ফিরে আসে, রক্তাক্ত করে অন্তর।
মুজিব হত্যাকাণ্ডের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একসময় বলেছিলেন, আমেরিকার বাইরে তার তিনজন শত্রু রয়েছেন। একজন শেখ মুজিবুর রহমান ও বাকি দুজন হলেন চিলির রাষ্ট্রপতি সালবাদোর আলেন্দে ও ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনায়ক নগুয়েন ভ্যান থিউ এবং যে কোনোভাবে তাদের উৎখাত করা ছিল তার রাজনৈতিক লক্ষ্য। এই তিনজনের মধ্যে শেখ মুজিবের প্রতি তিনি সর্বাধিক অসন্তুষ্ট ছিলেন; কারণ শেখ মুজিবের কারণেই ১৯৭১ সালে ‘পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ’ শুরু হয়, যার ফলে তিনি পাকিস্তানের সহায়তায় চীন-আমেরিকা সুসম্পর্ক তৈরির যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। শুধু তাই নয়, শেখ মুজিবের কারণে আমেরিকার ওই সময়ের রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বী ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক ছিল- যা ছিল আমেরিকার জন্য নেতিবাচক। তাই যে কোনো মূল্যে তিনি মুজিবকে উৎখাত করতে এবং বাংলাদেশে নিজেদের অনুকূল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে মনস্থ ছিলেন। বিশ্লেষকরা একমত- এটি নিছক হত্যাকাণ্ড নয়; বরং এর পেছনে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হত্যা মামলার রায়েও যেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ রয়েছে। তবে ইতিহাসের নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের যে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং তৎকালীন রাজনৈতিকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়টি বিচারকাজ শেষ হওয়ার পরও অনেকটা অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এদেশীয় কিছু সেনাসদস্য গোলাবিহীন ট্যাংক নিয়ে সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করে বেতার-টেলিভিশন দখল করে জাতিকে হত্যার সংবাদ জানাবে- বিষয়টি মোটেই এত সরলীকরণের সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা। জাতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে বিন্দুমাত্র ছাড়ে অনড় ছিলেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। একাত্তরের পাকিস্তানের পরাজয়ের সঙ্গে সমর্থনের কারণে মূলত তাদেরও পরাজয় ঘটে। অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে তখন স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। বিশ্ব রাজনীতি তখন টালমাটাল। আঞ্চলিক রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু বিশাল ফ্যাক্টর ছিলেন। স্বভাবতই স্নায়ুযুদ্ধের ভিকটিম হলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে উপমহাদেশের রাজনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেছন থেকে সেনাবাহিনীর উচ্ছৃঙ্খল সদস্যদের উসকে দিয়েছে। এছাড়া সর্বহারা পার্টি, ন্যাপ-ভাসানী, হক-তোহা, টিপু বিশ্বাস ও পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদারের নকশাল পার্টি মনে করত মুজিব সরকার ভারতের পাপেট সরকার। ভাসানীর ‘হক কথা’য় মুজিব ও ভারতের বিরুদ্ধে লেখা হতো। গবেষকদের মতে, মুজিব হত্যাকাণ্ডের দুটো ডাইমেনশন। একটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আরেকটি আন্তর্জাতিক। এর কোনটাই বিচারে উঠে আসেনি। দেশের প্রচলিত আইনে আর দশটা হত্যাকাণ্ড যেভাবে হয়ে থাকে সেভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে।
চিরঞ্জীব মুজিব : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নরপিশাচরূপি খুনিরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্ককের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরঞ্জীব- তার চেতনা অবিনশ্বর। বাঙালি জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে আছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবাদর্শে শানিত বাংলার আকাশ-বাতাস জল-সমতল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবাহমান থাকবে। জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি উন্নয়নশীল, মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।
শোকের মাসের কর্মসূচি : প্রতিবারের মতো শোকের মাস উপলক্ষে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে আগস্ট মাসের প্রথম প্রহরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক ধরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর অভিমুখে আলোর মিছিল করে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আলোক প্রজ্জ্বলন করে ছাত্রলীগ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও খাদ্য বিতরণ করে মৎস্যজীবী লীগ। আজ ১ আগস্ট বেলা ১১টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে কালো ব্যাজ ধারণ, রক্তদান কর্মসূচি, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল করবে কৃষক লীগ। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। মাসব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- শ্রদ্ধা নিবেদন, কোরআনখানি, দোয়া ও মোনাজাত, খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, আলোচনা ও শোক সভা, কালো ব্যাজ ধারণ, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ প্রভৃতি।