×

প্রথম পাতা

দুর্নীতির মচ্ছব

সম্পদ নিয়ে আমলাদের রাখঢাক

Icon

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সম্পদ নিয়ে আমলাদের রাখঢাক
   

সাবেক ও বর্তমান আমলাদের বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন নিয়ে তোলপাড় চলছে কিছুদিন ধরেই। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজির আহমেদ, এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও ফয়সাল আহমেদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে তদন্ত চলছে। আরো অনেকে নজরদারির মধ্যে আছেন। আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার সরকার ও বিরোধী দলের নেতারাও। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে গতকাল মঙ্গলবার আমলাদের সম্পদের হিসাব দেয়ার তাগিদ এসেছে উচ্চ আদালত থেকেও। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীরাও মনে করেন, অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য অভিযুক্তদের যেমন শাস্তি হওয়া দরকার; তেমনি সব আমলার সম্পদ বিবরণীও প্রকাশ্যে আনতে হবে। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে, আমলারা কী সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করবেন। গত বছর থেকে আয়কর আইনে আমলাদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশের কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করতে আমলারা অনেকটা ‘জেনেও না জানার’ ভান করে নিস্পৃহ ভাব দেখাচ্ছেন। আমলাদের আঁতুরঘর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো কথাই বলছে না। প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চাপে আমলারা তাদের সম্পদ বিবরণী জমা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে যেন বিষয়টি তামাদি হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত ও শৃঙ্খলা অনুবিভাগের প্রধান অতিরিক্ত সচিব আমেনা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। এরপর ওই শাখার যুগ্ম সচিব নাঈমা হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নই। আপনি শৃঙ্খলা অধিশাখা-২এ কর্মরত যুগ্ম সচিব ড. মো. নুরুল হকের সঙ্গে কথা বলুন। শৃঙ্খলা অধিশাখা-২এ কর্মরত যুগ্ম সচিব ড. মো. নুরুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, যা বলার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব বলবেন।

জানতে চাইলে টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারি কর্মজীবীদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশের আইন ও বাধ্যবাধকতা থাকার পরও বিষয়টি বাস্তবায়নে আদালত থেকে নির্দেশনা নিতে হয়। এরপরও যদি বিষয়টির বাস্তবায়ন না হয়- তাহলে সেটি সরকার ও সরকারি কর্মজীবীদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক হবে। নানা তথ্য উপাত্তের ব্যাখা দিয়ে তিনি বলেন, সরকারি কর্মজীবীদের সম্পদের বিবরণী দাখিলের বিষয়টি নিয়ে আমি আশাবাদী হতে পারছি না।

কারণ সম্পদের বিবরণী প্রকাশ না করার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে- তা থেকে তারা বেরিয়ে আসবেন, তা মনে করি না। তিনি বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যারা অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন; তারা সেই সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করে নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলবেন না। তবে আদালত থেকে নির্দেশনা আসায় হয়তো এটা নিয়ে কিছুদিন নড়চড়া হবে। চূড়ান্ত বিবেচনায় কিছুই হবে না।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরো বলেন, যাদের উপর আদালতের নির্দেশ পালন করার দায়িত্ব; তারা যদি এটি পালন না করেন- তাহলে আদালত অবমাননা হবে। এই অবমাননার বিষয়ে তারা কতটুকু বিচলিত- এই প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যায়।

এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের বেঞ্চ রুলসহ আগামী তিন মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনও দাখিলের আদেশ দেন। একই সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবী ও তাদের পরিবারের অবৈধ সম্পদ অর্জন রোধে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও আইন করতে নিস্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না; তা

জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এছাড়া সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। এই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আদেশের জন্য আগামী ২২ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন আদালত। আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এ কে এম ফজুলল হক। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস গত সোমবার রিটটি দায়ের করেন।

সরকারি চাকরিজীবী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ এর ১৩ ধারা অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের নিকট তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি এবং মোট ৫০ হাজার টাকা বা এর বেশি মূল্যের অলংকারাদিসহ স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা করবেন। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী প্রতি ৫ পাঁচ বছর পরপর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করবেন। এই বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের তথ্য প্রকাশের জন্য যথাযথ প্রয়োগের নির্দেশনা চেয়ে গত সোমবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস রিট আবেদন করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে পিয়ন, দারোয়ানসহ সব সরকারি চাকরিজীবীকে রিটার্ন দাখিল করার কথা বলা হয়। কিন্তু এটি সর্বজনীন হয়নি। এ অবস্থায় সরকারি কর্মচারীর জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার বিধানকে যৌক্তিক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, অনেক অল্প বেতনধারী কর্মচারীর একাধিক বাড়িসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে। তাদের বেতনের বাইরে আরো আয় থাকতে পারে। রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করায় সরকার তার সম্পদের তথ্য পাবে। পিয়ন, দারোয়ান কিংবা অফিস সহকারী- চলতি অর্থবছর থেকে সব কর্মচারীকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। না হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে।

আয়কর আইন, ২০২৩-এর এ বিধান মেনে সব গণকর্মচারীকে রিটার্ন দাখিল করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের আওতাভুক্ত দপ্তর-অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ই-টিআইএন সংগ্রহ করে রিটার্ন দাখিল করার নির্দেশনা শুরু করলেও সর্বজনীন হয়নি। এতদিন সরকারি চাকরিজীবীদের রিটার্ন দাখিল করতে হতো না। যাদের মূল বেতন ১৬,০০০ টাকা বা তার বেশি, তাদের জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক ছিল। চলতি অর্থবছর নতুন আয়কর আইন করেছে সরকার। তার বিভিন্ন ধারায় সকল গণকর্মচারীর জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করে বলা হয়েছে, গণকর্মচারীর বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তিতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ জমা দিতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, যেসব কর্মচারীর বেতন করসীমার চেয়ে কম, তাদের কোনো কর দিতে হবে না। তবে সবাইকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। আর যাদের বেতন করমুক্ত আয়সীমা অতিক্রম করে, তাদের আয়বর্ষের আনুমানিক মোট আয়ের জন্য প্রযোজ্য করের গড় হারে তার বেতন বিল থেকে উৎসে কর্তন করতে হবে। এ নির্দেশনা পাওয়ার পর করমুক্ত আয়সীমার চেয়ে কম বেতনভুক্ত কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে বলে একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন। অনেক কর্মচারীর বেতন কম হওয়া সত্ত্বেও নিজের নামে বড় অঙ্কের অর্থ সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ রয়েছে, তাদের উৎকণ্ঠা আরো বেশি। সব সরকারি কর্মচারীর জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার বিধানকে যৌক্তিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, অনেক অল্প বেতনধারী কর্মচারীর একাধিক বাড়িসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে। তাদের বেতনের বাইরে আরো আয় থাকতে পারে। রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করায় সরকার তার সম্পদের তথ্য পাবে। এছাড়া এর মধ্য দিয়ে রিটার্ন দাখিলকারীর সংখ্যা বাড়বে, ট্যাক্স নেটও বাড়বে। যেসব অল্প বেতনধারী কর্মচারীর অন্যান্য আয় ও সম্পদ আছে, সেসব আয় থেকে আয়কর পাওয়া যাবে। এতে রাজস্ব আহরণ বাড়বে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন। এর মধ্যে ১১তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত কর্মচারীর সংখ্যা ১২ লাখ ১৭ হাজার ২৬৪ জন। ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের প্রারম্ভিক মূলবেতন ৮২৫০ টাকা থেকে ১৬০০০ টাকা পর্যন্ত, যা করমুক্ত আয়সীমার চেয়ে কম। চলতি অর্থবছর করমুক্ত আয়সীমা ৩ দশমিক ৫০ লাখ টাকা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দেশের অনেক পিয়নেরও দুই-তিনটা বাড়ি আছে। সরকারি চাকরির বেতন কম হলেও তাদের অন্য ইনকাম থাকতে পারে। এই বিবেচনায় সব গণকর্মচারীর জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা যৌক্তিক হয়েছে। তিনি বলেন, কারো অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ বা ২০ লাখ টাকা পেলে যেন তাকে হয়রানি করা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একজন অল্প বেতনের চাকরিজীবীও দীর্ঘদিন অল্প অল্প টাকা জমিয়ে এই পরিমাণ টাকা সঞ্চয় করতে পারেন। তবে কারো অবিশ্বাস্য রকমের সম্পদ থাকলে সেগুলো নিয়ে তদন্ত করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কর্মরত অবস্থায় অর্জিত সম্পদের হিসাব দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না সরকারি চাকরিজীবীরা। পাশাপাশি অনেক মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট চাকরিজীবীদের কাছে সম্পদের তথ্য চায়নি। প্রসঙ্গত, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর সম্পদবিবরণী দাখিলের নিয়ম আছে। কিন্তু আমলারা বলেছেন, প্রতিবছর আয়কর বিবরণীতে সম্পদের হিসাব জমা দেয়া হচ্ছে। ফলে নতুন করে এখানে জমা দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ নেই কারো।

আরো পড়ুন:

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App