স্বর্ণ পাচারে বাঘববোয়ালরা

ইমরান রহমান, ঝিনাইদহ থেকে ফিরে :
প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

- সবকিছু জেনেও নিরব পুলিশ
- পাচারচক্রের হাত অনেক লম্বা
- আনারের মৃত্যু প্রভাব ফেলেনি
দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে নানা কৌশলে দেশে স্বর্ণ আসার পর সীমান্তে নিয়ে যান পাচারকারীরা। দেশের ১২টি জেলার সীমান্ত পথ দিয়ে এসব স্বর্ণ পাচার হয় পার্শ্ববর্তী দেশে- এটি কমবেশি সবারই জানা। এর মধ্যে যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলার সীমান্ত পথগুলো পাচারকারীদের কাছে জনপ্রিয়। যশোর ও চুয়াডাঙ্গা মহাসড়ক ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় বিভাজন হওয়ায় এই জায়গাটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই পাচার রুটের সব স্বর্ণই কালীগঞ্জ অতিক্রম করে সীমান্তে যায়। এরপরও রহস্যজনক কারণে কালীগঞ্জসহ পুরো রুটের সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে। চোরাচালান রোধে একটি চেকপোস্টও চোখে পড়ে না ঝিনাইদহ সদর থেকে কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর এলাকাগুলোতে।
এর কারণ হিসেবে কালীগঞ্জের সংসদ সদস্য কলকাতায় নির্মমভাবে খুন হওয়া আনোয়ারুল আজীম আনারের প্রভাবকে দায়ী করা হলেও এর পেছনে আরো বড় বড় রাঘববোয়াল রয়েছে বলে জানা গেছে। থানা পুলিশ কখনো স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযানে গেলে প্রভাবশালী ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের ফোনে পেছনে হটারও ঘটনাও রয়েছে। ফলে পাচারকারীরা মহাসড়ক দিয়েই নিরাপদে সীমান্তে স্বর্ণের চালান নিয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট জেলার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সূত্র বলছে, স্বর্ণের চোরাচালান ঠেকানো খুবই চ্যালেঞ্জের একটি কাজ। কেননা এটির পেছনে অনেক বড় পর্যায়ের লোকদের হাত থাকে। তাদের চোখের কাটা হওয়ার চেয়ে নীরব থাকাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। এদিকে, এমপি আনারের মৃত্যুতে সীমান্তের স্বর্ণ কারবারের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তাদের ভাষ্য, এই কারবারে আরো ‘অনেক আনার’ আছে; শিল্পপতি ও প্রভাবশালী পর্যায়ের লোক হওয়ায় যাদেরকে কেউ সন্দেহ করে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহের মহেশপুরের বাঘাডাঙ্গা, মাঠিলা, লেবুতলা, জোলুলী, সামান্তা সীমান্ত, চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গা, দর্শনা-গেদে সীমান্ত ও জীবননগর, যশোর জেলার বেনাপোল, শার্শার শ্যামলগাজী, শিকারপুর, ভবেরবেড়, দৌলতপুর, মনোহরপুর, ছুটিপুর, কাশিপুর, শালকোনা, পাকশিয়া এলাকা স্বর্ণ পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এর মধ্যে লেবুতলা, দর্শনা-গেদে সীমান্ত, জীবননগর, বাঘাডাঙ্গা ও যশোরের বেনাপোল ও দৌলতপুর স্বর্ণ পাচারের জন্য পছন্দের রুট ছিল হত্যাকাণ্ডের শিকার এমপি আনার ও আখতারুজ্জামান শাহিন সিন্ডিকেটের।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এমপির এই স্বর্ণ ব্যবসা সম্পর্কে সবকিছুই জানেন এমপি আনারের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) আবদুর রউফ, আনারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলি নোমান ও আনারের বন্ধু গোলাম রসুল। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এই কারবারে জড়িত প্রভাবশালী অন্যদের নামও বেড়িয়ে আসবে অনায়াসে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দর্শনা সীমান্তে মাস্টারপাড়ার মৃত এরশাদের ছেলে খেদু মিয়া, দক্ষিণচাঁদপুর স্টেশনপাড়ার হুজুর আলীর ছেলে মাসুম স্বর্ণ পাচারের অন্যতম বাহক হিসেবে কাজ করে থাকে। এছাড়াও আবদুল মান্নান খান, আসলাম আলী তোতা, দিপু রেজা, সাইদ খান ওরফে বাংলা, আলমগীর খান ওরফে আলম, মো. সোহেল, আশিক, রহিম, আরিফসহ অর্ধশত লোক বাহক হিসেবে কাজ করে। এদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারেও গিয়েছে। এরপরও জামিনে বেরিয়ে তারা একই কাজে লেগে পড়েন। এদের অনেকে জানেনই না- কার স্বর্ণ তারা পাচার করছেন।
মহেশপুরের বিভিন্ন সীমান্তে এমপি আনারের চালান পার করার কাজ করতেন আরজু ভূঁইয়া (ছদ্মনাম)। ভোরের কাগজের এই প্রতিবেদক কথা বলেন তার সঙ্গে। তিনি বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানে আরো অনেক এমপি আনার আছে। তার মৃত্যু স্বর্ণ পাচারে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আর কারা আছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, নাম করা শিল্পপতিদের কেউ কেউ এই কাজ করছে অনেক বছর ধরে। কিন্তু শিল্পপতিদের অঢেল টাকা থাকবে এটাই স্বাভাবিক- এই চিন্তা থেকে তাদের কেউ সন্দেহ করে না। এমপি আনার মহাসড়কগুলো সামলাতেন; তার মৃত্যুর পর রুটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল কিনা? জানতে চাইলে ওই কারবারী বলেন, মানুষের টাকার লোভ যতদিন থাকবে, পাচার কখনোই থামবে না। কয়েকস দশক ধরে তো চলছে; কেউ থামাতে পেরেছে? উল্টো প্রশ্ন করে বসেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, স্বর্ণের পাচার ঠেকাতে কড়া পদক্ষেপ নিতে গেলেই উচ্চ পর্যায় থেকে ফোন আসা শুরু হয়। পুলিশের জিআইজি কিংবা প্রভাবশালী একাধিক এমপি ফোন করে বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে বলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী ব্যক্তিও স্বর্ণ পাচারের পক্ষ নিয়ে তদবিরে নামেন। তার সঙ্গে এমপি আনারের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনেকটা ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন সমাবেশে আনার তার প্রশংসা করে বক্তব্যও দিতেন। এসব কারণে অতিরিক্ত ঝামেলা এড়াতে স্বর্ণ পাচার বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয় না থানা পুলিশ। আর এই স্বর্ণের কারবারে সংশ্লিষ্ট জেলার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা জড়িত থাকায় থানা পুলিশের আদতে কিছু করারও থাকে না। ফলে কখনো সখনো এক/দুটি চালান জব্দ হলেও সেগুলো বড় কোনো চালান থাকে না। সেগুলোর নেপথ্যের নায়করাও আইনের আওতায় আসে না।
জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, স্বর্ণ চোরাকারবারী বিপ্লব চ্যাটার্জির কাছ থেকে ১২০ ভরি স্বর্ণ উদ্ধারের পর মাদক বানিয়ে স্বর্ণ আত্মসাতের অভিযোগে ঝিনাইদহের সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) আলতাফ হোসেনকে ২০২২ সালে চাকরিচ্যুত করার পর পাচার সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশের নীরবতা আরো বেড়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বোঝাতে চাচ্ছেন, স্বর্ণ কারবারীদের সঙ্গে বিরোধে জড়ালে পরিণতি ভালো হয় না। এরচেয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়াই চাকরি টিকিয়ে রাখতে বেশি নিরাপদ বোধ করেন তারা। স্বর্ণ চোরাকারবারে মাথা না ঘামালেও মাদক পাচার ঠেকাতে সব থানা পুলিশই বেশি সোচ্চার থাকে বলে দাবি তাদের। মাঝে মধ্যে যে স্বর্ণের চালান ধরা পড়ে সেগুলো সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া মাদক উদ্ধার সংক্রান্ত অভিযানই বেশি বলে জানা গেছে।
পুলিশের ঝিনাইদহ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর আবিদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, স্বর্ণসহ যে কোনো চোরাকারবার ঠেকাতে পুলিশ সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে। স্বর্ণ কারবারীরা একটু কৌশলী হওয়ায় ধরা পড়ে কম। ৫৮ বিজিরির সিও কর্নেল আজিজ ভোরের কাগজকে বলেন, সীমান্তে যারা অবৈধ স্বর্ণের বাহক তারা খুবই সাধারণ মানুষ। তাদের গ্রেপ্তার করে নেপথ্যের নায়কদের সম্পর্কে জানা সম্ভব হয় না। আর স্বর্ণসহ যাদের আটক করা হয়- তাদের সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়। থানা পুলিশ পরবর্তী সময়ে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে এনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। সুতরাং পুলিশই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।
বিজিবির অভিযানে বেশির ভাগ সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় স্বর্ণ উদ্ধারের কারণ কি? জানতে চাইলে কর্র্নেল আজিজ আরো বলেন, আমরা যখন তথ্য পেয়ে অভিযানে যাই; তখন উপায় না পেয়ে কারবারীরা স্বর্ণ ফেলে পালিয়ে যায়। এটাই একমাত্র কারণ। তবে স্বর্ণের চোরাচালান থামাতে বিজিবি সবসময় সর্বোচ্চ তৎপর থাকে।
চোরাকারবারীতে আনারের উত্থান যেভাবে : একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালের দিকে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে আনার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। ভারতের বাগদা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের বাঘাভাঙ্গা সীমান্ত পথে চোরাচালান করতেন তিনি। ওই সময় কালীগঞ্জ থানাসহ মহেশপুর, কোটচাঁদপুর ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর থানা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তিতে ‘টোকেন’ তৈরি করে তার বাহিনী। ওই টোকেন দেখালেই প্রশাসনের লোকজন মাদকদ্রব্য বহনকারী গাড়ি ছেড়ে দিত। এই টোকেন বাণিজ্য থেকে আনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘মাদক সম্রাট’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই মাদক কারবারের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিকও বনে যান। ১৯৯১ সালে আনার ঝিনাইদহের আরেক চোরাকারবারী পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্বর্ণের বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাচার করতেন তারা।
১৯৯৬ সালে আনার বিএনপি থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের কারবারের সঙ্গে কালীগঞ্জ পৌরসভার এক কমিশনারের হাত ধরে অস্ত্র চোরাকারবারে জড়ান তিনি। তার অবৈধ অস্ত্রের চালান চরমপন্থি ক্যাডার সামসেল ওরফে রবিনের কাছে বিক্রি হতো। কথিত আছে, সরকারের পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ ভারতে আত্মগোপন করার পর তার মাধ্যমে অস্ত্র চোরাকারবার চালিয়ে যান আনার। বাগদা এলাকার মাদক সম্রাট জয়ন্ত কুমার, কার্তিক, গৌতম সাহা ও বনগাঁর দেবদাসের সঙ্গে আনারের মাদকের কারবার ছিল।
২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারীরা নিশ্চিত হয়- দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল। তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারীদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহিন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারী পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান। এ মামলায় আনারকে গ্রেপ্তারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। এর দশ দিন পর ওই বছরের ২১ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তারের জন্য নিশ্চিন্তপুর গ্রামে তার বাড়িতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমে যেতে শুরু করে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশির ভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার। আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন স্বর্ণ পাচারে।